বহুল আলোচিত স্ত্রী মিতু হ’ত্যামামলায় স্বামী সাবেক এসপি বাবুল আখতারকে পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গ্রেপ্তার করেছে। এর আগে ‌এই মামলার বাদি বাবুল আখতারকে তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই চট্টগ্রামে ডেকে নেয়।

মঙ্গলবার সকাল ১০টায় বাবুল আখতার উপস্থিত হন পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ে। সন্ধ্যায় পিবিআইয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা বাবুল আখতারকে গ্রেপ্তার দেখানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মঙ্গলবার বাবুল আখতারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চট্টগ্রামে পিবিআই কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

এদিকে, পিবিআই সূত্র জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বুধবার তাকে আদালতে হাজির করে গ্রেপ্তারের আবেদন করা হবে। মামলার বাদি তার স্বামী বাবুল আখতার। এ কারণে তাকে গ্রেপ্তার করার বিষয়টি আদালতের নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে।

২০১৬ সালের ৫ জুন সকাল ৭টা ১৭ মিনিটে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলে করে ৩ দু’র্বৃত্ত মিতুকে ঘিরে ধরে প্রথমে গু’লি করে। এরপর কু’পিয়ে পালিয়ে যায়। ওই সময় মিতুর স্বামী বাবুল আখতার পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন।

তার আগে তিনি চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। ঘটনার পর নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অ’জ্ঞাতদের আসামি করে মামলা করেন বাবুল আখতার। মামলাটি চট্টগ্রামের নগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ৩ বছর ১১ মাস তদন্তে থাকার পর গত বছরের মে মাসে মামলাটি পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) স্থানান্তর করা হয়।

মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা হলেন পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা। তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু বাবুল আখতার মামলার বাদি। তাকে আটক করা হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডের আবেদন বুধবার আদালতে পাঠানো হবে।

সেই কল রেকর্ড:

২০১৬ সালের ৫ জুন সকাল ৭টা ৩৭ মিনিটে এই ঘটনায় জড়িত মুছার মোবাইল ফোনে কল যায় তৎকালীন এসপি বাবুল আখতারের মোবাইল ফোন থেকে। মাত্র ২৭ সেকেন্ডের মোবাইল ফোনের কথোপকথনের রেকর্ডটিই এখন মামলার প্রধান আলামত ও সাক্ষী। সালাম দিয়ে মুছা ফোনটি রিসিভ করতেই ওপার থেকে বাবুল বলেন, ‘তুই কো’পালি ক্যান? ৩/৪ সেকেন্ড থেমে আবার বলেন, বল তুই কো’পালি ক্যান? তোরে কো’পাতে কইছি? অপর পাশ থেকে মুছা বলেন, ‘না মানে…’।

বাবুল আখতার ফোনটি কেটে দেন। এই ২৭ সেকেন্ড কলের কথোপকথনের রেকর্ড পেয়েই ঘটনার ১৯ দিন পর ২০১৬ সালের ২৪ জুন রাতে বনশ্রীর শ্বশুরের বাসা থেকে বাবুলকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার কিছু দিন পর বাবুল আখতার পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেন।

এরপর বাবুল দুই সন্তান আখতার মাহমুদ মাহী ও তাবাসুম তাজনিন টাপুরকে নিয়ে ঢাকার বনশ্রীর ভূঁইয়া পাড়ার শ্বশুরবাড়িতে উঠেছিলেন। তবে কয়েক মাস পর আলাদা বাসা ভাড়া করে সন্তানদের নিয়ে চলে যান। বাবুল আখতার পরে মগবাজারে আদ-দ্বীন হাসপাতালের কর্মকর্তা হিসাবে যোগদান করেন।

বাবুল-মিতুর সম্পর্কে ফাটল যে কারণে:

পরকীয়া প্রেমের এসএমএস নিয়ে বাবুল আখতারের স্ত্রী মিতুর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে হ’ত্যাকাণ্ডের ৭ মাস আগে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে বাবুল আখতারের মোবাইল ফোন থেকে মিতু আপত্তিকর কিছু এসএমএস দেখতে পান। সেখানে গায়েত্রী এম্মার্সিং নামের এক ভারতীয় নারীর সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কের তথ্য জানতে পারেন মিতু। এ নিয়ে বাবুল-মিতুর মধ্যে প্রতিদিনই ঝ’গড়া হতো।

মিতুর পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৫ সালের ডিসেম্বরের এক বাবুল আখতার বিছানার ওপর মোবাইল ফোন রেখে বাথরুমে যান। এ সময় একটি এসএমএস আসে বাবুলের মোবাইলে। তখন মিতু এসএমএসটি চেক করে দেখতে পান একটি আপত্তিকর বার্তা। তখন মিতু মোবাইলটির সুইচ বন্ধ করে বাসার স্টোর রুমে ফোনটি লুকিয়ে রাখেন।

এরপর বাবুল আখতার ফোন খোঁজাখুঁজি করলে মিতু ফোনের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেন। পরদিন বাবুল বাসা থেকে বের হলে মিতু মোবাইলের সিম বের করে মোবাইলটি অন করেন। এরপর ওই মোবাইল থেকে একে একে ২৯টি এসএমএস (ক্ষুদে বার্তা) পড়েন। পরে এ ব্যাপারটি মিতু প্রমাণ হিসেবে ছেলের ছবি আঁকার আর্ট পেপারে লিখে রাখেন।

এদিকে মোবাইল না পেয়ে বাবুল আখতার ট্র্যাকিং করে নিশ্চিত হন, তার মোবাইল ফোনটি বাসাতেই রয়েছে। এই মোবাইল ফোন নিয়ে তাদের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। বিষয়টি নিয়ে পরদিন মিতু ফোন দেয় তার মায়ের কাছে।

কী ছিল সেসব ম্যাসেজে:

মিতুর মায়ের দাবি করা একটি আর্ট পেপারে লেখা ২৯টি ম্যাসেজের সবগুলোই ইংরেজিতে লেখা। ম্যাসেজগুলোতে গায়েত্রী ও বাবুলের মধ্যে গভীর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একটি ম্যাসেজে এমন লেখা হয়েছে, ‘মাই পোয়েট মাই লাভ কাম টু মি। লাভ ইউ মাই কিং উড হ্যাভ কিসড ইউ প্যাশোনেটলি, ইফ ইউ ওয়্যার হিয়ার নাউ, লাভ ইউ বেবি, গুড মর্নিং, কাম হিয়ার টু স্লিপ উইথ মি’।

গায়েত্রী এম্মার্সিং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক ইউএনএইচসিআর প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে প্রতিরোধ শাখার একজন কর্মকর্তা হিসাবে কক্সবাজারে কর্মরত ছিলেন। ২০১৩ সালে তখন বাবুল আখতার কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বর্তমানে গায়েত্রী এম্মার্সিং সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় কর্মরত।

যেভাবে ঘটেছিল:

২০১৬ সালের ২৪ জুন বাবুল আখতারের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে ওই বছরের ২৬ জুন আনোয়ার ও মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম নামে ২ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানায় পুলিশ। তারা আদালতে দেওয়া স্টেটমেন্টে বলে, কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুছার পরিকল্পনাতেই এ হ’ত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়।

স্টেটমেন্টে ওয়াসিম জানায়, নবী, কালু, মুছা ও তিনি (ওয়াসিম) মিশনে সরাসরি অংশ নেয়। ঘটনার সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের সামনে ছিল মুছা, এরপর আনোয়ার ও একদম পেছনে ছিল সে। মোটরসাইকেলের পিছন থেকে সে প্রথমে মিতুকে গু’লি করে। জিইসির মোড়ে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা নবী তার বুকে, হাতে ও পিঠে স্ট্যাব করে।

পুরো সময়টা বাবুল আখতারের ছেলেকে আটকে রেখেছিল মুছা। এরপর তারা চলে যায়। পরে এ ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই আসামি নূরুন্নবী ও রাশেদ পুলিশের ক্রস- ফা’য়ারে নিহ’ত হয়। মুছাসহ ২ আসামি গুম হয়ে গেছে। এই মামলায় বর্তমানে ওয়াসিম ও আনোয়ার গ্রেপ্তার হয়ে জেলে। নবী, কালুসহ ৩ জন জামিনে মুক্ত আছেন।