বাংলাদেশ, , মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

বন্ড লাইসেন্স নিয়ে গুরুতর অনিয়ম: ১৩২ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই

বাংলাদেশ পেপার ডেস্ক ।।  সংবাদটি প্রকাশিত হয়ঃ ২০১৯-০৭-০৪ ১৪:৫৬:৩২  

বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকায় ২৩২টি প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান যাতে পণ্য আমদানি করতে না পারে, সেজন্য তাদের ব্যবসা শনাক্তকরণ নম্বর (বিআইএন) লক করা হয়েছে।

এর মধ্যে কাগজে-কলমে অস্তিত্ব থাকলেও বাস্তবে কারখানা নেই ১৩২টি প্রতিষ্ঠানের। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বন্ড সুবিধার আওতায় বিনা শুল্কে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করে আসছে।

এসব কাঁচামালের মধ্যে সুতা, কাপড়, কাগজ, এক্সেসরিজ, পিপি দানা খোলা বাজারে বিক্রি করাই হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ। একশ্রেণির অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তার সহায়তায় চক্রটি ফ্রি স্টাইলে দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর নির্ধারিত বিভিন্ন স্পটে বন্ডের পণ্য দেদার বিক্রি করে আসছে। এ কারণে অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে দেশীয় বস্ত্র শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।

এদিকে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সূত্র জানায়, অভিযুক্ত ২৩২টি প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স চূড়ান্তভাবে বাতিল করার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। এজন্য কারণ দর্শানো নোটিশ পাঠানো হচ্ছে।

পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের ব্যাংক হিসাব জব্দের মাধ্যমে পাওনা আদায়ের উদ্যোগ নেয়া হবে। এখানে পাওনা বলতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির পর যে পরিমাণ গার্মেন্ট পণ্য রফতানি করার কথা, তা যারা করেনি তাদের কাছ থেকে সমপরিমাণ পণ্যের ডিউটি আদায় করা হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্দেশে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট ভুয়া ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান শনাক্তে মাঠ পর্যায়ে জরিপ শুরু করে। বন্ড কর্মকর্তারা টঙ্গী, আশুলিয়া, গাজীপুর, সাভার, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মিরপুর, উত্তরার বিভিন্ন বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানে সরেজমিন পরির্দশন করে।

১ জানুয়ারি থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত ৬ মাসে পরিদর্শন করে ২৩২ প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের খোঁজ পায়। এর মধ্যে ১৩২ প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বহীন। অর্থাৎ কাগজে-কলমে এসব প্রতিষ্ঠান থাকলেও বাস্তবে কারখানা নেই। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের তালিকা পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বন্ড সুবিধায় শূন্য শুল্কে কাঁচামাল আমদানি করলেও নিজস্ব কারখানা নেই।

অথচ শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাপড়সহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির পণ্য এনে পুরান ঢাকার ইসলামপুর, নয়াবাজার, বাবুবাজার, মতিঝিলের আরামবাগে বিক্রি করে ব্যাপক বাণিজ্য করে আসছিল। ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় বস্ত্রশিল্পের উদ্যোক্তারা।

অস্তিত্বহীন ১৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- থ্রিএমএস টেক্স (বিড), অ্যাকটিভ সোয়েটার লিমিটেড, আলম ইন্ডাস্ট্রিজ, আনারকলি নিটওয়্যার লিমিটেড, আরাফ নিটওয়্যার, বি. ব্রাদার্স গার্মেন্টস, বিআর নিটিং মিলস, বাংলাদেশ ড্রেসেস লিমিটেড, বন অ্যাসোসিয়েটস, বাংলাদেশ কাওয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো. লিমিটেড, থ্রেডস লিমিটেড, বেঙ্গল জিনস লিমিটেড, ব্লুটেক্স নিটওয়্যার লিমিটেড, বডি স্ট্রিস বাংলাদেশ লিমিটেড, ব্রাইট পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, সিটাস ইন্টারন্যাশনাল বিডি লিমিটেড, চৈতি ক্লাসিক স্পোটর্সওয়্যার লিমিটেড, চিটাগং ফ্যাশন প্যাকেজিং অ্যান্ড প্রিন্টিং লিমিটেড, চুন জি নিট লিমিটেড, কমান্ডো ফ্যাশন লিমিটেড, দারদা নিটওয়্যার লিমিটেড, ঢাকা কার্টুন অ্যান্ড প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, ডায়মন্ড প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, দোতি ফ্যাশন লিমিটেড, ইস্ট এশিয়া অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড, ইস্টার্ন পেপার কনভারটিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, ইজি অ্যাকসেসরিজ কোম্পানি লিমিটেড, অ্যাপকট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, এভার ব্রাইট পলি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইভিন্স অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড, এক্সএনসিভ ফ্যাশন লিমিটেড, এক্সপোর্ট এইড প্রাইভেট লিমিটেড (ইউনিট-২), ফা অ্যাপারেলস লিমিটেড, ফিডাস অ্যাপারেলস লিমিটেড, ফিন ফ্যাশন লিমিটেড, ফরচুন অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড প্রভৃতি।

ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকা বন্ড কমিশনারেটের আওতায় প্রায় ৫ হাজার লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ৭০ ভাগের বেশি চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত। মূলত দুইভাবে বন্ডের পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।

প্রথমত, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে বন্ড লাইসেন্স খুলে পণ্য আমদানি করে। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কাঁচামাল শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করে। আমদানি প্রাপ্যতা নির্ধারণ পদ্ধতির দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই এ কাজটি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

অনেক প্রতিষ্ঠানের রফতানি আদেশ যৎসামান্য থাকলেও কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে শুধু মেশিনের উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী প্রাপ্যতা নির্ধারণ করিয়ে নিচ্ছে। এভাবে আমদানি করা অতিরিক্ত কাঁচামাল তারা খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে।

মাঝেমধ্যে দু-একটি চালান বন্ড কর্মকর্তাদের অভিযানে ধরা পড়লেও বেশির ভাগই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৩২ নয়, অন্তত বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের ৩০ শতাংশের অস্তিত্ব নেই।

জানা গেছে, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই কালোবাজারে শুল্কমুক্ত পণ্য বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এ চক্রটি বন্ডের কাপড় চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে খালাস হয়ে ঢাকার আশপাশের পাইকারি বাজারে নিয়ে যায়। রাতের আঁধারে নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়, চিটাগাং রোড, কাঁচপুর এলাকায় কাপড়বোঝাই গাড়ি আনলোড হয়।

এজন্য চিটাগাং রোডের অনেক বাসা-বাড়িতে অস্থায়ী গোডাউনও গড়ে উঠেছে। এসব গোপন গোডাউন থেকে সুবিধামতো সময়ে কাপড় হাতবদল হয়। নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে সুতা, পুরান ঢাকার ইসলামপুরে বন্ডের কাপড়, নয়াবাজারে কাগজ ও উর্দু রোডে পিপি দানা বিক্রি হয়।

বন্ডের অপব্যবহার রোধে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট প্রিভেন্টিভ শাখা গঠন করেছে। আগে প্রিভেন্টিভ বলতে মাঝেমধ্যে লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের গোডাউন পরিদর্শন করে কাঁচামাল আমদানি তথ্য ও মজুদের তথ্য মিলিয়ে দেখা হতো।

কাঁচামাল কম পাওয়া গেলে অবৈধ অপসারণের দায়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হতো। সহকারী কমিশনার ও উপকমিশনারদের নেতৃত্বে ৮টি দল গঠন করা হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই রাতে প্রিভেন্টিভ টিমের সদস্যরা টহল দিচ্ছেন।

বন্ড কর্মকর্তারা বলছেন, ইপিজেডের প্রতিষ্ঠান থেকে বন্ডের পণ্য খোলাবাজারে বেশি বিক্রি হচ্ছে। কারণ ইপিজেডের ভেতরের প্রতিষ্ঠানে কাস্টমসের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। এসব প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রফতানির অনুমোদন বেপজা থেকে নেয়।

ফলে অতিরিক্ত পণ্য আমদানির সুযোগ থাকে। সম্প্রতি নীলফামারী ইপিজেডের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বন্ডের আওতায় আনা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রির সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বন্ডের চৌকস কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রিভেন্টিভ টিম গঠন করা হয়েছে। এ টিমের সদস্যরা দিনের নির্ধারিত ডিউটি শেষে রাতে ইসলামপুরে ঢোকার রাস্তাগুলো যেমন জিপিও মোড়, নয়াবাজার মোড় ও বাবুবাজার মোড়ে নিয়মিত অবস্থান নিয়ে ট্রাক তল্লাশি করছে। কিন্তু সীমিত লোকবল ও লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে নিয়মিত অভিযান চালানো সম্ভব হয় না।


পূর্ববর্তী - পরবর্তী সংবাদ
       
                                             
                           
ফেইসবুকে আমরা