বাংলাদেশ, , মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

‘হিজাব বিতর্ক’, পেছনে যা আছে

বাংলাদেশ পেপার ডেস্ক ।।  সংবাদটি প্রকাশিত হয়ঃ ২০২২-০৪-১১ ০০:০০:১০  

নওগাঁ প্রতিনিধিঃ

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে গত বুধবার মুসলিম ছাত্রী ছাড়াও মুসলিম ছাত্র ও সনাতন (হিন্দু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী) ধর্মাবলম্বী ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ড্রেস পরে না আসার জন্য বেত্রাঘাত করেন দুই শিক্ষক। তবে কেন শুধু শিক্ষিকা আমোদিনী পালের বিরুদ্ধে হিজাব পরার কারণে ছাত্রীদের মারধরের অভিযোগ উঠল?

এছাড়া বিদ্যালয়ে হামলার ঘটনার বিষয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর মধ্যে চলছে নানান আলোচনা।

শনিবার দুপুরে দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিনিধি।

বিদ্যালয়টিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিযোগকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে দুইজন ছাত্রীর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় তারা কেউ বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়নি। ওই দুই ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বাড়িতে গেলে তাদের একজনের বাড়ি তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। অপরজনকে বাড়িতে পাওয়া গেলেও সে ও তার অভিভাবকরা কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি।

তবে বুধবার ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল দাবি করে বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, সেদিন সকালে স্কুলের সমাবেশ বা অ্যাসেম্বলির সময় ছেলে ও মেয়েদের লাইনের সামনে সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পাল, শারীরিক শিক্ষক বদিউল আলম ও সহকারী শিক্ষক সুনিতা রাণী মণ্ডল উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশ শেষ হওয়ার পর উপস্থিত শিক্ষকরা যেসব শিক্ষার্থী স্কুলের নির্ধারিত পোশাক (স্কুল ড্রেস) পরে আসেনি এমন ১৮-২০ জন শিক্ষার্থীকে আলাদা করেন।

পরে সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পাল স্কুল ড্রেস পরে না আসা ছাত্রীদের এবং শারীরিক শিক্ষক বদিউল আলম ছাত্রদের বেত্রাঘাত করেন। এ সময় তারা স্কুল ড্রেস পরে না আসার জন্য ছাত্রছাত্রীদের ভর্ৎসনা ও বকাঝকা করেন। স্কুল ড্রেস পরে না আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে হিন্দু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ছাত্রছাত্রীও ছিল।

স্কুল ড্রেস পরে না আসার জন্য মারধরের শিকার হওয়া সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের মধ্যে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রমি পাল ও দিপা রাণী এবং ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী কবিতা রাণী জানায়, আমরা কয়েকজন স্কুল ড্রেস পরে না আসায় আমোদিনী ম্যাম বকাঝকা করেন। গাছের ডাল দিয়ে আমাদের হাতে কয়েকটা করে বাড়িও দেন। স্কুল ড্রেস না পরা মেয়েদের মধ্যে কয়েকজনের মাথায় ওড়না ও হিজাব পরা ছিল। ছেলেদের মারেন বদিউল স্যার।

তাদের দাবি, আমোদিনী পাল সেদিন হিজাব নিয়ে ছাত্রীদের কোনো কথা বলেননি।

ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত ছিল বলে দাবি করা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দশম শ্রেণির দুই ছাত্রী বাংলাদেশ পেপারকে বলে- আমোদিনী পাল ম্যাম ও বদিউল স্যার মূলত স্কুল ড্রেস পরে না আসার কারণেই ছাত্রীছাত্রীদের মেরেছেন।

তবে তাদের মধ্যে হিজাব পরে থাকা কয়েকজন ছাত্রীর উদ্দেশ্যে বকা দেওয়ার সময় ম্যাম (আমোদিনি) বলেন, মহাদেবপুর বাজারে মার্কেট করার সময় তো তোমাদের হিজাব পরতে দেখি না, আর স্কুলে হিজাব পরে আসো। আর হিজাব যদি পরতেই হয়, তাহলে স্কুল ড্রেসের সঙ্গে মিল করে পরে আসবা। হিজাব পরে আসার জন্য তাদেরকে মারা হয়েছে বলে যেভাবে বলা হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়। অন্যদেরও ম্যাম বকা দিয়েছেন।

সেদিন বেত্রাঘাতের মুখে পড়া দশম শ্রেণির ছাত্র বিপ্লব পাল ও সজিব হোসেন বলে, স্কুল ড্রেস পরে না আসার জন্য এর আগেও স্যার-ম্যাডামদের কাছে বকা খেয়েছি। বদিউল স্যার প্রথমে আমাদের ছেলেদের মারে। এরপর ম্যাডাম ছাত্রীদের মারে।

তাদের দাবি, ছাত্রীদের মারার সময় আমোদিনী পাল কি বলে বকা দিয়েছেন তা তারা শুনতে পায়নি।

সেদিন সমাবেশে উপস্থিত থাকা শিক্ষক সুনিতা রাণী মণ্ডল বলেন, স্কুল ড্রেস না পরার জন্য ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষক আমোদিনী পাল ও বদিউল আলম মেরেছেন এটা ঠিক। তবে আমোদিনী পাল ম্যামকে ওই সময় ছাত্রীদের হিজাব নিয়ে কথা বলতে আমি শুনিনি।

শারীরিক শিক্ষক বদিউল আলম স্কুল ড্রেস পরে না আসার ছাত্রদের বেত্রাঘাতের ঘটনাটি স্বীকার করেছেন।

ঘটনার পর শনিবার বিদ্যালয়ে পাঠদান করিয়েছেন শিক্ষিকা আমোদিনি পাল। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে আমোদিনী পাল ছাত্রীদের বেত্রাঘাত করার কথা স্বীকার করে বলেন, হিজাব পরে এসেছে বলে ছাত্রীদের মারা হয়েছে এ কথা ঠিক নয়। স্কুল ড্রেস পরে না আসার জন্য মাঠের মধ্যে পড়ে থাকা মরা গাছের ডাল দিয়ে আমি কয়েকজন ছাত্রীকে হালকা শাসন করেছি। আমাদের আরেক শিক্ষক বদিউল আলম স্কুল ড্রেস না পরার জন্য ছাত্রদের শাসন করেন। আমরা দুজনেই শিক্ষার্থীদের শাসন করেছি তাহলে শুধু আমাদের অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলো? আমাকে হেয় করার জন্য বা একটা উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য একটা মহল ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার’ ছড়িয়েছে।

ছাত্রীদের বেত্রাঘাতের সময় হিজাব নিয়ে কিছু বলেছেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, হিজাব নিয়ে কোনো কথাই ছাত্রীদের বলিনি। হিজাবের বিষয়টি কীভাবে আসল আমি বুঝতে পারছি না। এই বিদ্যালয়ে আমি প্রায় ২২ বছর ধরে চাকরি করছি, কেউ বলতে পারবে না কোনো দিন ধর্মবিদ্বেষী কোনো কথা আমি বলেছি।

তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে দাবি করে তিনি অভিযোগ করেন, প্রধান শিক্ষক ধরনী কান্ত পাল আগামী ১০ মে অবসরে যাবেন। এরপর নিয়ম অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক হওয়ার কথা আমার। তবে বর্তমান প্রধান শিক্ষকসহ স্কুলের আরও কিছু শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির কিছু সদস্য চান না আমি প্রধান শিক্ষক হই। আমাকে বিপদে ফেলার জন্য এ চক্রটি স্কুলড্রেস পরে না আসার জন্য ছাত্রীদের শাসন করার ওই ঘটনাকে পরিকল্পিতভাবে হিজাব বিতর্ক হিসেবে ছড়িয়েছে এবং অভিভাবকদের উস্কে দিয়ে স্কুলে হামলা চালিয়েছেন। পরদিন অসুস্থ থাকায় স্কুলে না আসায় হামলার হাত থেকে আমি বেঁচে গেছি। আমাকে স্কুল থেকে সরানোর জন্য প্রধান শিক্ষক আমাকে শোকজ করেছেন।

চক্রান্তের অভিযোগে প্রধান শিক্ষক ধরনী কান্ত বর্মণ বাংলাদেশ পেপারকে বলেন, বুধবার সমাবেশে ছাত্রছাত্রীদের মারার ঘটনার দিন আমি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে গিয়েছিলাম। পর দিন অনেক অভিভাবক স্কুলে দল বেঁধে এসেছিলেন। তারা বেশ উত্তেজিত ছিল। তাদের অভিযোগ, আমোদিনী পাল মেয়েদের হিজাব পরার জন্য মারধর করেছেন। এমন পরস্থিতিতে আমি তৎক্ষণাৎ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে কথা বলি। শিক্ষা অফিসারের পরামর্শে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ওই দিনই আমি আমোদিনী পালকে শোকজ করি। এখানে কোনো চক্রান্ত হয়নি। আমি তো কয়েক দিন পর অবসরেই যাচ্ছি। এখানে স্কুলে কে প্রধান শিক্ষক হলো আর না হলো তাতে আমার কী যায় আসে?

তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার স্কুলে অভিভাবকদের হামলার সময় স্থানীয় কিছু সাংবাদিক ও পুলিশের সামনেই হিজাব পরার কারণে আমোদিনী পাল মারধর করেছেন বলে অভিযোগ করে। ওই সব কথা ফেসবুকে পরে ভাইরালও হয়েছে।

ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির আহবায়ক দাউল বারবাকপুর গ্রামের বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান বলেন, যেদিন স্কুলে হামলার ঘটনা ঘটে সেই দিনই আমাদের কমিটি অনুমোদন পেয়েছে। এখানে হিজাব ইস্যু নিয়ে একটা উত্তেজনা ছড়ানো হয়েছে এবং সেই ঘটনা তদন্তে প্রশাসনের তরফ থেকে তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত হলেই প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসবে- এখানে চক্রান্ত হয়েছে না অন্য কিছু হয়েছে?

জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বাংলাদেশ পেপার’কে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশনা অনুযায়ী ঘটনাটি গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় একটি বিভাগীয় তদন্ত হবে। বিষয়টি আমি নিজেই দেখছি। হিজাব হোক বা স্কুল ড্রেস; যে কারণেই হোক শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা যাবে না- এ ধরনের সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। তদন্তে কারও বিরুদ্ধে সরকারি নির্দেশনা ভঙ্গের প্রমাণ পেলে অবশ্যই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শিক্ষা বিভাগের পাশাপাশি এ ঘটনা তদন্তে প্রশাসনের তরফ থেকে গত বৃহস্পতিবার মহাদেবপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন কার্য দিবসের মধ্যেই এ কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।


পূর্ববর্তী - পরবর্তী সংবাদ
       
                                             
                           
ফেইসবুকে আমরা