রাষ্ট্র তুমি কার? ধর্ষকের না ধর্ষিতার?

প্রকাশিত: ৬:৪২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২, ২০২০

 

চারিদিকে ধর্ষণের হাহাকার। আমি আপনি সবাই দর্শক। কিন্তু কেন? এরকম হাজার প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। একটা নিরব চিৎকার, ধর্ষিতা মা বোনের আর্তনাত আমাদের শিহরিত করে না। করলেও এর প্রতিবাদ নিয়ে কয়েকদিন মিছিল মিটিং করে স্যোসাল মিডিয়াতে সরব থাকি, স্থায়ী সমাধান না করেই ভুলে যায় সব।

বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা যেন পেশায় পরিনত হয়েছে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে।
বেশ কয়েকদিন ধরে সারাদেশে ধর্ষণের চিত্র চোখে পড়ার মত। খাগড়াছড়ি, সিলেটের এমসি কলেজ, চট্রগ্রাম সহ কক্সবাজার টেকনাফের বাহারছড়া এবং গতকাল সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারেও। এমন পরিস্থিতির জন্যে কাকে দায়ী করা উচিত?

এই পৃথিবীর মানুষ কাউকে রক্ষা করে না,করতে জানে না। এরা জানে ভিডিও,ছবি ভাইরাল করতে,এরা জানে মোমবাতি প্রজ্বলন করতে,এরা জানে মিছিল মিটিং করতে। আমিও তাদের দলে বারবার স্ট্যাটাস দিয়ে যারা নীরব প্রতিবাদ করে।

আজ নিজের জীবনের চিন্তাধারা, অভিজ্ঞতাও বাস্তবতার সম্মুখিন হওয়ার কিছু কথা আপনাদের শেয়ার করছি।
প্রেমিকার পোশাক নিয়ে আমার কখনও কোন মাথাব্যথা ছিল না। তার মন চাইলে সে সালোয়ার কামিজ পরত। মন চাইলে জিন্স। কোন অনুষ্ঠানে হলে শাড়ি। বছর খানেক আগে একবার আমরা যখন কক্মবাজার শৈবাল বিচের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম, বিচের ছাতা চেয়ারের একটু সামনে আমাদের দিকে তাকিয়ে একটা ছেলে বলে উঠল, ‘কচি কচি ডাব’। আমি থমকে দাঁড়ালাম, মেয়েটা আমার হাত ধরে বুঝাইল কোন শব্দ করার দরকার নাই। সময়টা তখন বিকেল পাঁচটা হবে। আশেপাশে লোকের অভাব নাই।

এর বাইরে কখনও উটকো মন্তব্য শুনি নাই এমন না। তবে খুব ভয়াবহ কিছু হয় নাই। তবে হ্যাঁ, দুইবার টুরিষ্ট পুলিশ যা হ্যারাস করছে তা ‘পাড়ার ছেলে’রাও করে না। অথচ আমরা কোন হোটেলে ধরা পড়ি নাই, হেটে বাসায় ফিরছিলাম।

পুলিশের কথাটা এই কারণে তুললাম যে নিরাপত্তা বিধান করা যাদের দায়িত্ব ছিল তারাই সন্ধা কিংবা রাতে রাস্তা দিয়ে ঘরে ফেরা প্রেমিক প্রেমিকাকে ধরে নানা রকম জেরা করে কয়েকটা নোট নেওয়ার জন্য, সেখানে বর্তমানে নেহায়েত ধর্ষকামীরা কতদূর যেতে পারে তার কোন সীমা আসলেই নেই।

লিখতে লিখতে এখন আমার মনে হচ্ছে এসব কেন লিখছি? সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব লিখে আসলে কিছু হয় না কেননা যারা এসব পোস্টে সহমত দেই তারাই পরে এসবে লিপ্ত হয়।

আমাদের প্রথম সমস্যা ছিল (এটা এখন কমে গেছে) ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করা। আমাদের আমজনতা এতই বুদ্ধিমান যে ফেক আইডি থেকে আসা এই ধরণের কিছু ‘দ্বীনদার’ ভাইয়ের কমেন্টকে তারা সিরিয়াসলি নিয়ে নতুন কথা চালু করলেন, ‘ধর্ষকই ধর্ষণের একমাত্র কারণ’। মূলত দুটো ধারনাই ভুল। পোশাক ধর্ষণের কারণ না কিন্তু প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এইকথা বলার জন্য আমার সমালোচনা করতে পারেন, তবে নগদে না করে আরেকটু পড়ে নিলে ভালো হয়।

সমস্যা নানা রকম,সমস্যা আমাদের শিক্ষায়, আমাদের সোশ্যাল স্ট্রাকচারে। বয়ঃসন্ধিকালেই যৌনতা সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা হয় ভুলভাবে। সেখান থেকে সেক্স, সেক্সুয়াল লাইফ তো পরের বিষয় আমরা বিপরীত লিঙ্গের মানুষদের (পুরুষ নারীকে, নারী পুরুষকে) ভুল দৃষ্টিতে দেখি। এই দেখার বিষয়টি বা দাম্পত্য, নারী পুরুষের যৌন জীবন নিয়ে আমাদের ভুল ধারণা থেকে কেউ কেউ বেরিয়ে আসতে পারলেও সবাই পারে না। যাদের কিছু শিক্ষা দীক্ষা থাকে তারা মানিয়ে নিতে পারে, বাকিরা পারে না।

আর যেখানে শিক্ষার অভাবটা বেশি সেখানে জিনিসগুলো বাজে ভাবে বেড়ে ওঠে ক্যানসারের মতো। শ্রেনী সংঘাত কাজ করে কখনও কখনও। যেমন ওয়ার্কিং ক্লাসের (মজুর, শ্রমিক শ্রেণী) মানুষদের মধ্যে একটা ধারণা থাকে কলেজ ইউনিভার্সিটির মেয়েরা ‘অশ্লিল’। আমি অশ্লিল এই কথাটাই ব্যবহার করলাম কেননা কথাটা আমি এদের মুখ থেকেই শুনেছি। আর ওদের এই ধারণার কারণ কখনও কখনও আমরাই। কেননা আমরাই টঙে বসে আলাপ করি কে কয়জনকে ‘খেয়ে দিছি’। চুমু খাওয়া কোন দোষের বিষয় না কিন্তু রিকশায় বসে চুমু খাওয়ার আগে চিন্তা করা প্রয়োজন এই চুমুটা রিকশাওয়ালার কাছে কোন বার্তা পৌঁছাবে। বিদেশি সিরিয়াল দেখে দেখে পরকীয়াকে আমরা যেমন নরমালাইজ করে ফেলেছি, সস্তায় অনেক কিছু দেখে ওরাও অনেক কিছু নরমালাইজ করতে পারে।

চিন্তা করা প্রয়োজন এই কারণে কেননা যদিও আমি কলেজ ভার্সিটি পড়ুয়া একটা ছেলে এই মানসিকতা রাখতে পারি যে অশালীন কাপড় পরা একজনের স্বাধীনতা এমনকি সে ছোট জামা পরে রাস্তায় বের হলেও তাকে টিজ করার অধিকার আমার নেই, কিন্তু সিএনজি টমটম, বা বিচ কর্মীরা সেটা বুঝবে না, কিংবা সমুদ্র সৈকতে কাজ করা সেই মধ্যবয়েসী লোকটা হয়ত বেশি ভাববে না। আবার দ্বীনি বানী দেওয়া কেউ হয়ত দেখছেন তারই বয়সের এক ছেলে লীলা করে বেড়াচ্ছে কিন্তু সে কিছু করতে পারছে না। তার নীতি তাকে বাঁধা দেয়, কিন্তু প্রবৃত্তি তাকে পীড়িত করে। তাই একদিকে আমাদের দেশে পর্দা করা নারী এবং পর্দা করতে বলা পুরুষ বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়ছে পরকীয়া।

লেখাটা জটিল হয়ে যাচ্ছে। এই পর্যন্ত যদি কেউ পড়ে থাকেন একটু তলিয়ে ভাবুন, আমি পোশাকের কিংবা চলাফেরার দোষ দিচ্ছি না। ছোট ছোট বিষয় মানুষের মনের উপর কী প্রভাব ফেলে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করছি। কোন মনোবিদ আমার চেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন অবশ্যই। কিন্তু এসব বিষয় আমলে নেওয়া যথেষ্ট জরুরি। বিভিন্ন ধরণের মানুষ যৌনতাকে বিভিন্ন ভাবে দেখে। এর পাশাপাশি সিনেমা, পর্ণ এমনকি আমাদের একজনের যৌন জীবন অন্য অনেকের যৌনতায় প্রভাব ফেলে। সেসব কোন না কোন ভাবে কখনও ধর্ষণের সাথে যুক্ত হয়। একজন পুরুষের লিঙ্গোত্থান সব সময় ধর্ষণে পর্যবসিত হয় না।

এটা গেল পরিবেশ, শিক্ষা, মনস্তাত্ত্বিক ব্যপার। এর পাশাপাশি আরেকটা আছে, ক্ষমতা। গ্রামের বা শহরের বাইরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক ধর্ষণের খবর পত্রিকায় আসে। কখনও শুধু শিরোনাম দেখেই আমরা মন্তব্য করে দেই। কখনও এক কলাম তিন ইঞ্চি খবর পড়েই আমরা সব বুঝে যাই। দোষ হয় একতরফা ধর্ষিতার কিংবা ধর্ষকের সাথে সমস্ত পুরুষ জাতির। আদতে এসব ধর্ষণের পেছনে অনেক সময়েই থাকে গ্রামীণ রাজনীতি, জমিজমা, পারিবারিক ঝগড়া। সেসব কখনও পত্রিকায় আসে না।

পত্রিকা বা মিডিয়ায় কখনও কখনও আসে রাজনৈতিক নেতাদের বা দলের মদদপুষ্ট নেতা, পাতি নেতা বা ক্যাডারের ধর্ষণের খবর। আমরা কিছুদিন সেই দলের মুণ্ডুপাত করি, তারপর বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় সব ভুলে যাই। মূলত এসব ধর্ষণের কারণ অনেক সময়েই ক্ষমতার বিস্তার, দৃঢ় করা। অনেক সময় ধর্ষিতা হয়ত তাদের বহুদিনের টার্গেটও থাকে না। সে কেবল বলির পাঁঠা হয়ে যায়।

ধর্ষণ কেবল আজ হচ্ছে এমন না। হয়ে আসছে বহুদিন ধরে। তাই একটা রাজনৈতিক দলের দোষ দেওয়াটা ভুল। শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলের দোষ দেওয়া ভুল। কেননা এই পদ্ধতি সব দলই চালু রেখেছে। আজকের মাঠ আগেই প্রস্তুত করা। বিশ্বাস না হলে পুরনো খবর পড়ে দেখতে পারেন। কোন সরকার, কোন রাজনৈতিক দলের সময়েই ধর্ষণ কম হয়নি। তবে হ্যাঁ, তখন এতো শহজে খবর পেতাম না। এখন পেয়ে যাই। কিন্তু পেলেও কী? আমাদের ভুলতে সময় লাগে না। আর ভোলার ব্যবস্থাও আমরাই করি। আমরা তখন ভুলে গিয়েছিলাম বলেই এখন এতো সুযোগ পাচ্ছে।

বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমাদের বর্তমান সময়ে সম্পর্কগুলো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। বিশেষত নারী-পুরুষের সম্পর্ক, সেটা দাম্পত্য হোক, প্রেম বা বন্ধুত্ব। আর যাওয়ার অন্যতম একটা কারণ ধর্ষণের এই বিস্তার এবং এই নিয়ে তুমুল ‘ভুল আলাপ’। একদল প্রমাণ করতে চায় পুরুষের যৌন চাহিদাই ধর্ষণের কারণ। আদতে এর পেছনে কী কী কাজ করে সেসব কেউ বলে না।

আমাদের ব্যক্তিগত ভাবে এতো ক্ষমতা নেই যে ক্ষমতার চর্চা কিংবা রাজনৈতিক ধর্ষণের কোন সুরাহা করতে পারব। তবে হ্যাঁ, সবাই একত্র হয়ে দাঁড়ালে সম্ভব। কিন্তু এই সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধের যুগে সেটা হবে বলে মনে হয় না। এক পারি নিজের পরিবার, পার্টনার, বন্ধুর কাছে নিজের স্বচ্ছতা প্রমান করতে। নিজের বলয়ের মানুষকে বোঝাতে। তাতে যেটুকু নিজের বৃত্তে ভালো হয় ততটুকুই লাভ।

তবে আমাদের মূলত প্রয়োজন একটা প্রতিষ্ঠান, যারা প্রতিটা ধর্ষণের তথ্য যোগাড় করবে। মোটিভ জানবে। ধর্ষকের মনস্তত্ত্ব যাচাই করবে। এসব কেস স্টাডি করে কার্যকারণ খুঁজে বের করতে পারলে আমার বিশ্বাস মানুষকে, পুরুষকে ছোটবেলা থেকে গ্রুম করলে কেবল ধর্ষণ না, নারীর প্রতি সহিংসতাও কমা সম্ভব। আর শুধু পুরুষ না, নারীরও গ্রুমিং প্রয়োজন। কিন্তু এভাবে কাজ করা সম্ভবত সরকারী প্রণোদনা ছাড়া সম্ভব না। সে সরকার দেবে না, দিলেও কোন মন্ত্রী, এমপি বা তার ড্রাইভার খেয়ে ফেলবে।

মৃত্যুদণ্ড, সর্বসমক্ষে করেও এই দেশে ধর্ষণ কমবে না। বিচি কেটে দিলেও না। রোগের চিকিৎসা করতে হলে রোগের কারণ, ধরণ জানতে হয়। আমাদের সেদিকেও মনোযোগ নেই। আমরা কেবল রোগ হওয়ার পর অ্যান্টিবায়োটিক দিতে চাই। এখনও সময় আছে আসলে। আমরা চাইলেই পারি। একটু সদিচ্ছা প্রয়োজন। পোস্ট কপচানো কমিয়ে কিছু কাজ প্রত্যেকে করলেই হবে।

ছোট বড় অনেক বিষয় নিয়ে এসেছি। কিছু বিষয়ে আরও বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন ছিল হয়ত।

সোশ্যাল মিডিয়া বাংলাদেশ না, বাংলাদেশের একটা ক্ষুদ্র অংশ। দেশ আর দেশের মানুষ দেখতে হলে পথে চোখ কান খোলা রাখলেই হয়। সেটা করলে আমরা এতো ভুল বকতাম না।

লেখাঃ সিয়াম মাহমুদ সোহেল।

সাবেক ছাত্রনেতা,সমাজকর্মীও গনমাধ্যমকর্মী।