বাংলাদেশ, , বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

মানবিক ডাক্তার নূরুল হক: স্মৃতিতে অম্লান।

বাংলাদেশ পেপার ডেস্ক ।।  সংবাদটি প্রকাশিত হয়ঃ ২০২০-০৬-১৭ ২৩:৫১:০৬  

তখন আমি মহেশখালীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার। মহেশখালীতে জয়েন করার কিছুদিন পর দেখা দিল প্রচন্ড ব্যাকপেইন। তখনও লোকজনের সাথে তেমন জানাশুনা হয়নি মহেশখালীতে। রামুতে সহকারী কমিশনার হিসেবে কাজ করার সুবাদে অনেক শুভাকাংখি তৈরি হয়েছিল এবং তাদের অনেকের সাথে যোগাযোগও ছিল। এমনই একজন হলেন রামুর রশিদনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল করিম সাহেব। যেদিন ঢাকা থেকে মহেশখালীতে জয়েন করতে আসলাম সেদিন রামুর বেশ কিছু লোক কক্সবাজারের বিআইডব্লিউটিএ ঘাট পযন্ত আমাকে এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে করিম চেয়ারম্যানও ছিলেন। সেসময় মহেশখালী চ্যানেলের ভাটাজনিত প্রচন্ড স্রোত দেখে খুব ভয় পেয়ে আমার জন্য দোয়া করছিলেন বারবার।
করিম চেয়ারম্যানকে ফোন দিয়ে ব্যাকপেইনের কথা জানালাম।

তিনি বললেন বিকেলে কক্সবাজার চলে আসেন। সন্ধ্যায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। কক্সবাজারের ছয় নম্বর ঘাটে উনি গাড়ি পাঠালেন। ড্রাইভার বললেন, চেয়ারম্যান সাহেব আপনাকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেছেন। অসুস্থ্য মানুষ কথা না বাড়িয়ে চলে গেলাম উনার বাসায়। সন্ধ্যার আগে বললেন, আপনাকে কষ্ট করে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। ডাক্তারকে বাসায় আসতে বলেছি, তিনি আমার আত্মীয়। জানলাম ডাক্তার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তার। বাসা চট্টগ্রামে। সেখানেই প্রাইভেট হাসপাতালে প্র্যাকটিস করেন। সপ্তাহে একদিন কক্সবাজারে রোগি দেখেন। আমি লজ্জিত হয়ে বললাম না উনাকে আসতে বারণ করেন। আমিই উনার চেম্বারে যাবো একটু কষ্ট হলেও। চেয়ারম্যান হাসি দিয়ে বললেন, আপনি আমার শ্যালকরে চিনেন না। এমন মাটির মানুষ আর হয় না। আমি যখন যেখানে যেতে বলি কখনই না করবেন না।

কিছুক্ষণ পর ডাক্তার সাহেব আসলেন। উনাকে দেখে কথা বলে বুঝলাম প্রথাগত নিয়মনীতির অনেক উদ্ধে একজন মানুষ তিনি। বাড়ি মহেশখালীতেই। অসম্ভব ভালো মানুষ। মোবাইল নম্বর দিয়ে বললেন কাল সকালে একটু জেনারেল হাসপাতালে আসবেন। দু’একটা টেস্ট করাতে হবে। সকালে তিনিও আসলেন। হাসপাতালের সবার কাছে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। যথাসময়ে সব টেস্ট হলো। রিপোর্ট তিনি নিজেই দেখলেন। তারপর কিছু ঔষধ লিখে দিলেন। ঔষধপত্র নিয়ে চলে আসলাম মহেশখালী। শারিরীক মানসিকভাবে একদম সুস্থ্য।

তার কিছুদিন পর রোজার ঈদ ছিল। করিম চেয়ারম্যান ঈদের দিন সে প্রিয়মুখ ডাক্তার নূরুল হককে নিয়ে আমার বাসায় আসলেন। যথাসম্ভব মেহমানদারি করলাম। তারপর থেকে তিনি প্রায়ই আমাকে ফোন দেন। শরীরের খোঁজখবর নেন। কক্সাবাজার আসলেও জানতে চান আমি কক্সবাজার আসবো কিনা অথবা চট্টগ্রামে গেলে যেন অবশ্যই দেখা করি। আসলে মানুষ সামাজিকতা রক্ষাথে এমন কথা অনেকেই বলেন। কিন্তু নুরুল হকের কথা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি যেদিন যেতাম আমাকে অনেক সময় দিতেন।

অত্যন্ত ভালোমানের নাস্তা কিংবা খাবার সময় হলে খাওয়ার আয়োজন করে ফেলতেন। লোকটাকে মাঝেমাঝে পাগল মনে হতো। চেম্বারে বসলে দুটো রোগি আসবে, দুপয়সা উপার্জন হবে। তা না করে মেহনমানদারিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কথা প্রসঙ্গে একদিন বললেন আপনার মতো প্রশাসন, পুলিশ, বিচারবিভাগ ছাড়াও সরকারি বিভিন্ন পযায়ের অনেক অফিসারের সাথেই আমার এমন সখ্যতা আছে। তারা অনেকেই আমাকে ভালোবাসেন। আমিও বলি আপনার মতো লোককে ভালো না বেসে পারা যায়?

একবার আমার একটা বাচ্চাকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে নেয়া দরকার হলো। ফোন দিলাম নুরুকে । সব ব্যবস্থা করে ফেললেন। যেদিন চট্টগ্রামে আসলাম সেদিন তিনি নিজের কাজ ফেলে ছুটে গেলেন সেখানে। নিজের কোন আত্মীয়স্বজনের মতো সব কাজ করলেন। কাজ শেষে খাওয়া দাওয়ার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করছিলেন। কিন্তু আমাদের নিজেদের অন্য কাজ ছিল বলে বিদায় নিয়েছিলাম।

কোলেস্টরেল এর বাড়তিজনিত কারণে মাঝেমাঝেই বুকে ব্যথা অনুভব করে আসছি অনেকদিন ধরে। মহেশখালী এবং পরে বান্দরবানের কর্মকালে অনেকবার চট্টগ্রাম আসতে হয়েছে । কখনো নিজেই ব্যবস্থাপত্র দিতেন, কখনো কখনো প্রয়োজন বুঝে অন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন। ডাক্তার দেখানো, টেস্ট করানো সব কাজ নিজ দায়িত্বে করতেন। আমার এক পর নির্ভরযোগ্য অবিভাবক ডাক্তার নুরুল হক।
তখন আমি বান্দরবানে কর্মরত। একদিন বিকেলে জেলা প্রশাসক স্যার বললেন, আমার শরীরটা যেন কেমন একটু খারাপ লাগছে। সাথেসাথেই নুরুকে ফোন দিলাম। বললেন, স্যারকে নিয়ে চলে আসেন। স্যারকে তিনি নিজে ব্যবস্থাপত্র দেননি।

অন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। কিছু টেস্ট দেয়া হলো, কিছুক্ষণ পর রিপোর্ট আসলো। সব ঠিক আছে। স্যারও আরামবোধ করছেন। এবার ধরলেন রাতের খাবার খেয়ে যেতে হবে। রোদেলা বিকেল রেস্টুরেন্টে খাওয়াবেন। আমরাও আগে থেকেই চিন্তা করে রেখেছিলাম আমরা সেখান থেকে রাতের খাবার খেয়ে বান্দরবানে ফিরব। আর নুরুও এমনভাবে ধরলেন কিছুতেই না করতে পারলাম না।
সিলেটে আসার পর প্রথমদিকে কয়েকবার কথা হয়েছে। সিলেটে বেড়াতে আসার ইচ্ছা জানিয়েছে। করোনার এ সময়টাতে বেশ কিছুদিন যোগাযোগ করা হয়ে উঠেনি। গতসপ্তাহটা বারবারই মনে হচ্ছিল ফোন দিয়ে একটু খোঁজখবর নিই এবং কিছু পরামর্শ নিই। দেব দেব করে আর দেয়া হয়ে উঠল না।

গতকাল বিকেলেই জানতে পারলাম মানবতার সেবক ডাক্তার নুরুল হক লাইফ সাপোর্টে। করিম চেয়ারম্যানকে ফোন দিলাম। কান্নাজড়িত কন্ঠে জানালেন আমার শ্যালকের খবর শুনেছেন। জানতে চাইলেন লাইফ সাপোর্ট থেকে কি রোগি ফিরে আসে না? আমি বললাম, আসে তবে কম। তিনি বললেন আমি কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করছি ওর জন্য। কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দিলাম।

ফেসবুকে বারবার নুরুকে নিয়ে দেয়া স্ট্যাটাসগুলো দেখছি। অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীই উনার জন্য দোয়া কামনা করছেন। রাত আড়াইটাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম সে মর্মন্তিক সংবাদ, ডাক্তার নুরুল হক আর নেই। এমন নিরহংকার, পরোপকারী, সরল জীবন যাপনকারী, অতিথিপরায়ন, মানবিক, ধার্মিক একজন মানুষকে হারিয়ে আমি অনেক মর্মাহত। আল্লাহ মহেশখালীর এ কৃতিসন্তানকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন।


পূর্ববর্তী - পরবর্তী সংবাদ
       
                                             
                           
ফেইসবুকে আমরা