বাংলাদেশ, , মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

কক্সবাজার ও লামায় ৯ মাসে ফাঁদ পেতে ১১ বন্যহাতি হত্যা!

বাংলাদেশ পেপার ডেস্ক ।।  সংবাদটি প্রকাশিত হয়ঃ ২০২০-০৬-১৪ ২১:৩৩:০২  

কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ এবং বান্দরবানের লামা বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর একের পর এক বন্যহাতি হত্যার মহোৎসব চলছে। শুধুমাত্র গত ৯ মাসে এই তিন বনবিভাগের বিভিন্নস্থানে ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়েছে অন্তত ১১টি বন্যহাতি। কোথাও বিদ্যুতের তারে সংযোগ দিয়ে, আবার কোথাও হাতির বিচরণক্ষেত্রে অন্য কায়দায় ফাঁদ পেতে এসব হাতিকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ উঠেছে।

তবে বনবিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বরাবরের মতো দায়িত্ব এড়ানোর পন্থা অবলম্বণ করছেন। তারা বলছেন, ‘পরিকল্পিত নয়, হাতিগুলোর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।’

তবে এই দাবি সত্য নয় বলছেন অনেকেই।

সর্বশেষ চকরিয়া-লামা সীমান্তের লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি খালখুইল্যা খোলার একটি পাহাড়ি ঝিরিতে বন্যহাতি পড়ে থাকার সন্ধান পায় এলাকাবাসী। এই হাতিটিকেও পরিকল্পিতভাবে বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়েছে। যার বৈদ্যুতিক শকের দাগ হাতিটির শরীরে বিদ্যমান রয়েছে। মেরে ফেলা এই হাতিটি পুরুষ এবং আনুমানিক বয়স ১৫ বছর। ওজন প্রায় দেড় টন।

এ প্রসঙ্গে বান্দরবানের লামা বনবিভাগের সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান দাবি করেন, হাতিটি ওপর থেকে ঝিরিতে পড়ে গিয়ে মারা পড়েছে। হাতিটির সুরতহাল প্রতিবেদনের সময়ও শরীরের কোথাও কোন জখমের দাগ নেই। তাই হাতিটি মাটিচাপা দেয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন বিভাগের এক কর্মকর্তা কক্সবাজার ভিশন ডটকমকে দিয়েছেন ভিন্ন তথ্য। তিনি বলেন, ‘বাস্তব সত্য হচ্ছে, হাতিটিকে বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদ পেতে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। যার প্রমাণ মারা যাওয়া হাতিটির শুঁরে বড় একটি জখম রয়েছে। সেই জখমটি বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার। এরপরও বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দায়িত্ব এড়াতে গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন নিজেদের দোষ ঢাকতে।’

কক্সবাজার ভিশন ডটকমের অনুসন্ধান এবং বন্যহাতি বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, এসব হাতির আবাসস্থল তথা অভয়ারণ্য (বিচরণক্ষেত্র) ধ্বংসের পাশাপাশি বন উজাড়, পাহাড় ও বৃক্ষ নিধন, বারুদ বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে পাথর উত্তোলন ছাড়াও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর হাজার হাজার জনবসতি স্থাপন করায় চরম খাদ্যসংকটে পড়েছে বন্যহাতি। এছাড়াও খাদ্য উপযোগী বাগান গড়ে না তোলা, বনের ভেতর আকাশমণি প্রজাতির গাছের বাগান সৃজন করা, চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালীর উচিতারবিল মৌজায় সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় এবং হাতির অভয়ারণ্য ধ্বংস করে অবৈধভাবে ইটভাটা স্থাপন অন্যতম।

বন্যহাতি বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থায় মানুষের সাথে হাতির দ্বন্ধ প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। এসব হাতি খাবারের সন্ধানে প্রতিনিয়ত লোকালয়েও হানা দিয়ে আসছে। এতে হাতির আক্রমণে বিপুল সম্পদ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মারা যাচ্ছে মানুষও। একইসাথে সংরক্ষিত বনভূমিতে স্থাপিত জনবসতিতে নির্বিঘ্নে জীবন-যাপন করতে বিভিন্ন কায়দায় ফাঁদ পেতে হাতিকেও হত্যা করছে মানুষ।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দেয়া তথ্যানুযায়ী, গত ৯ মাসে কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বনবিভাগ এবং পাশ্ববর্তী বান্দরবানের লামা বনবিভাগের চকরিয়া-লামা সীমান্তের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় ১১টি বন্যহাতি ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়েছে। তন্মধ্যে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন চকরিয়ার ফুলছড়ি রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ৪টি, কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের ঈদগড়ের ভোমরিয়াঘোনায় ১টি, উখিয়ায় ১টি, টেকনাফের হ্নীলায় ১টি, হোয়াইক্যংয়ে ১টি, বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুমারী, ফাঁসিয়াখালীসহ তিন এলাকায় ৩টিসহ সর্বমোট ১১টি বন্যহাতিকে ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়েছে। নিজেদের ধানক্ষেত, বিভিন্ন ফলজ বাগান ছাড়াও বনভূমিতে নির্মিত বসতি রক্ষা করতেই বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদ বসানোসহ নানা কায়দায় হাতিগুলোকে হত্যা করা হচ্ছে।

সর্বশেষ মারা যাওয়া বন্যহাতিটির ব্যাপারে তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া যায় পিলে চমকানো তথ্য। লামার ফাঁসিয়াখালীর খালখুইল্যা এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা কক্সবাজার ভিশন ডটকমকে জানান, শনিবার সকালে পাহাড়ি ঝিরি থেকে বন বিভাগের উদ্ধার করা মৃত হাতিটিকে বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর আগের দিন অর্থাৎ প্রায় ১২ ঘন্টা আগে একই এলাকায় আবদুর রহিম (২২) নামক এক যুবকও বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি পাইন্যারঝিরি এলাকার মৃত রমিজ উদ্দিনের ছেলে।

লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাকের হোসেন মজুমদার কক্সবাজার ভিশন ডটকমকে বলেন, ‘ওই যুবক নিজের একটি গরুকে আনতে যান শুক্রবার মাগরিবের সময়। এ সময় আগে থেকে আমবাগানের চারিদিকে দেয়া বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ
হারায় ওই যুবক।’

আশার কথা শুনিয়েছেন কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম। তিনি কক্সবাজার ভিশন ডটকমকে বলেন, ‘রেঞ্জের ফুটেরঝিরি এলাকায় বন্যহাতি তথা পশু খাদ্যের উপযোগী ৪০ হেক্টর বনায়ন সৃজন করা হচ্ছে। এডিবির অর্থায়নে এই পশুখাদ্যের এই অভয়ারণ্য তৈরির কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।’

এ ব্যাপারে বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ কক্সবাজার জেলার সভাপতি দীপক শর্মা দীপু কক্সবাজার ভিশন ডটকমকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা বন ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করছি। আমাদের সংগঠন পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছি। যারা এই নিকৃষ্টতম কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত রয়েছে, তারা কিন্তু বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণে।’

তিনি বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে আমাদের দাবি হচ্ছে, যারা প্রকৃতির বন্ধু বন্যহাতির ওপর এমন বর্বর আচরণ করছেন, ফাঁদ পেতে একের পর এক হাতি হত্যা করছেন চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তা নাহলে অতি উৎসাহী হয়ে তারা বারবার এমন কাণ্ড ঘটাবেন।’

পরিবেশবাদী দীপক শর্মা দীপু আক্ষেপ করে বলেন, সম্প্রতি ভারতের কেরালায় একটি অন্তঃসত্ত্বা হাতিকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে সেই দেশের সংস্থা। কিন্তু আমাদের কক্সবাজার এবং আশপাশে গত ৯ মাসে ১১টি হাতিকে ফাঁদ পেতে হত্যা করা হলেও কারো বিরুদ্ধে একটি মামলাও রুজু করা হয়নি। এ কারণে দিন দিন ফাঁদ পেতে হাতি হত্যার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা বাড়ছে।’

উখিয়া, টেকনাফসহ কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় বন্যহাতি মারা যাওয়া প্রসঙ্গে বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মো. হুমায়ন কবির কক্সবাজার ভিশন ডটকমকে বলেন, ‘বন্যহাতিকে রক্ষায় আমরা ইতোমধ্যে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। দক্ষিণ বনবিভাগের বিভিন্ন এলাকায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। যার নাম হচ্ছে ‘প্রটেক্টেড এরিয়া ওয়াইল্ড লাইফ করিডর বনায়ন’ প্রকল্প। পাঁচবছরের জন্য নেয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়ে গেলে বন্যহাতি আর খাবারের সন্ধানে নির্দিষ্ট এলাকা ছেড়ে কোথাও যাবে না এবং তারা রক্ষা পাবে। আর ফাঁদ পেতে হাতি হত্যার বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’


পূর্ববর্তী - পরবর্তী সংবাদ
       
                                             
                           
ফেইসবুকে আমরা