বাংলাদেশ, , শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

বন্দি ঘরে কেমন আছ বাবা, অনেক দিন তোমার বুকে ঘুমাই না!

বাংলাদেশ পেপার ডেস্ক ।।  সংবাদটি প্রকাশিত হয়ঃ ২০২০-০৬-০৬ ১৯:৫৩:৪৪  

‘বন্দি ঘরে কেমন আছো বাবা? আমি তোমার সঙ্গে ঘুমাতে চাই। তোমার সঙ্গে ঘুমাতে অনেক ভালো লাগে বাবা। অনেকদিন তোমার সঙ্গে ঘুমাই না। একা একা ঘুমাতে আমার অনেক কষ্ট হয় বাবা।’

জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে বাবাকে লক্ষ্য করে কথাগুলো বলছিল সাড়ে তিন বছরের আলিশাবা রহমান ইবতিদা। উত্তরে বাবা বললেন, ‘এইতো সোনামণি। শিগগিরই আমরা একসঙ্গে ঘুমাব মা। তোমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাব।’

এরই মধ্যে আলিশাবা ও তার বাবার আবেগঘন কথোপকথনের এই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। বাবা-মেয়ের কথা শুনে অনেকেই অশ্রুসিক্ত হয়েছেন।

আলিশাবার বাবা আব্দুর রহমান মুকুল বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত)। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। পরিবার ও প্রিয়জনদের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে দূরে রাখতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাসার একটি রুমে নিজেকে বন্দি করে রেখেছেন তিনি।

ভিডিওতে দেখা যায়, আলিশাবা তার বাবার সঙ্গে কথা বলছে। আলিশাবা বাবাকে বলে, ‘বাবা তুমি কেমন আছো? আমি তোমার সঙ্গে ঘুমাতে চাই। তোমার সঙ্গে ঘুমাতে অনেক ভালো লাগে বাবা। অনেকদিন তোমার সঙ্গে ঘুমাই না। একা একা ঘুমাতে আমার অনেক কষ্ট হয় বাবা।’

উত্তরে আলিশাবার বাবা বলেন, ‘এইতো সোনামণি। শিগগিরই আমরা একসঙ্গে ঘুমাব মা। তোমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাব। তোমার কষ্ট হয় মা। আলিশাবা বলে হ্যাঁ। বাবা বলেন, কোথায় কষ্ট হয় মা। আলিশাবা বলে বুকে কষ্ট হয় বাবা।’

আবেগঘন ৫৫ সেকেন্ডের এই ভিডিও বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ‘বিএমপি মিডিয়া সেল’ নামে ফেসবুক পেজে শুক্রবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে পোস্ট দেয়া হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়।

শনিবার দুপুর ১টা পর্যন্ত এই ভিডিও সাড়ে আট হাজার মানুষ দেখেছে। ১৪৪ জন মন্তব্য করেছেন।
অনেকেই বাবা-মেয়ের এই ভালোবাসাকে সম্মান জানিয়েছেন। শিগগিরই বাবা-মেয়ে কোলে তুলে আদর করবে, সে দোয়াও করেছেন কেউ কেউ।

একজন বলেছেন, ‘এটা বেদনার ঘটনা। এটি মর্মস্পর্শী। আমার আশা, বাবা দ্রুত সুস্থ হয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরবে।’

আরেকজন মন্তব্য করেছেন, ভিডিও দেখার পর আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি। চোখের পানি ধরে রাখা মুশকিল। বোঝা যাচ্ছে পুলিশ কর্মকর্তার পরিবার কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দোয়া করি সবকিছুই দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।

পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান মুকুলের স্ত্রীর নাম তাসমিম ত্রোপা। ২০০৯ সালে তারা বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা নগরীর গোরেস্থান রোডের একটি বাসায় বসবাস শুরু করেন। বিয়ের সাত বছর পর কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে শিশুসন্তান আলিশাবা। সুন্দরভাবে জীবন চলছিল তাদের। করোনার কারণে হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল সবকিছু।

বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুল ইসলাম বলেন, আব্দুর রহমান মুকুল কর্তব্যপরায়ণ একজন পুলিশ কর্মকর্তা। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি জনগণের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সদস্যদের তদারকি ও মামলার তদন্তকাজ চালিয়ে গেছেন। দায়িত্বপালন করতে গিয়েই তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। দোয়া করি দ্রুত সুস্থ হয়ে তিনি কজে ফিরবেন।

হোম আসোলেশনে থাকা আব্দুর রহমান মুকুল বলেন, ২৬ মে থানায় ছিলাম। দুপুরে কিছুটা অসুস্থবোধ করি। বাসায় ফিরে বিশ্রাম নিই। হঠাৎ অনুভব করি শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। থার্মমিটার দিয়ে মেপে দেখি তাপমাত্রা ১০২। রাতে জ্বর বেড়ে যায়। সঙ্গে দেখা দেয় কাশি ও গলাব্যথা। সন্দেহ হয়, করোনা না তো। সেদিন থেকেই বাসার মধ্যে আলাদা রুমে থাকা শুরু করি। জ্বর ও গলাব্যথা বাড়লে ২৯ মে এপ্রিল করোনা টেস্ট করাই। দুইদিনের মাথায় আক্রান্ত হওয়ার খবর জানতে পারি।

কীভাবে আক্রান্ত হলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ঈদের আগে মার্কেটে ও বাজারে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে টানা কয়েকদিন দায়িত্বপালন করেছি। এ সময় ভিড় ঠেকাতে মানুষের কাছাকাছি যেতে হয়েছে। হয়তো তখন সংক্রমিত হয়েছি।

পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুর রহমান মুকুল বলেন, এক ছাদের নিচে থাকলেও ২৬ মে থেকে একটি রুমে আলাদা থাকছি। মেয়েটাকে কাছে পেলেও ছুঁতে পারছি না। তাকে দেখতে পাব, ধরতে পারব না। এটা আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন। ওকে একটু কোলে নিতে মনটা ছটফট করে। পেশার কারণে জীবনে অনেক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি। তবে এত কঠিন বাস্তবতা সামনে আসবে ভাবিনি।

আব্দুর রহমান মুকুল বলেন, আলিশাবাকে ঘিরেই আমার সব স্বপ্ন। তাকে ঘিরেই আমার দুনিয়া। রাতে দায়িত্বপালন করে বাসায় না ফেরা পর্যন্ত জেগে থাকতো আলিশাবা। বাসায় ফিরলে ছুটে এসে কোলে উঠতো। রাতে আমার বুকে মাথা দিয়ে ঘুমানো আলিশাবার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত ১২ দিন আলিশাবা থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। আলিশাবার কষ্ট দেখ নিজেকে ঠিক রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আব্দুর রহমান মুকুল বলেন, আলিশাবা প্রথম রাত অনেক কেঁদেছে। বাবাকে ছাড়া সে কিছুতেই ঘুমাবে না। তবে এখন কিছুটা সামলে নিয়েছে।

এখন জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আলিশাবা বলে, আল্লাহ করোনা উঠিয়ে নাও। বাবাকে সুস্থ করে দাও। বাবা সুস্থ হলে মা আর আমি ঈদের জামা পরে সেজে প্রজাপতির দেশে বেড়াতে যাব।

আব্দুর রহমান মুকুল বলেন, এই সময়টা বড় কঠিন। তবে এই সময়ে অনেক মানুষ, সহযোগিতা করেছে আন্তরিকভাবে। কয়েকজন সহকর্মী রান্না করে খাবার রেখে গেছেন, কেউবা বাজার করে দিয়ে গেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন। তারা সাহস জোগাচ্ছেন। কিছুটা ভালো আছি।

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান বলেন, আব্দুর রহমান মুকুলের সঙ্গে আমিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যোগাযোগ রাখছেন। পুলিশ হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিচ্ছেন। তিনি সুস্থ আছেন। তিনি যাতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পান সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, জনগণের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রায় দুই হাজার সদস্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। নগরীর সর্বত্র নিয়মিত টহল, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থাও করছে পুলিশ। পাশাপাশি করোনা শনাক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেয়া, কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা, শ্রমজীবী মানুষকে সহায়তা, রাস্তায় জীবাণুনাশক ছিটানো, অসহায়-কর্মহীন মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পৌঁছানোসহ করোনা প্রতিরোধে যে মহাযজ্ঞ; তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। দায়িত্বপালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত কর্মকর্তাসহ বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ৯৮ জন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৪ করোনামুক্ত হয়েছেন।
সুত্র: জাগোনিউজ


পূর্ববর্তী - পরবর্তী সংবাদ
       
                                             
                           
ফেইসবুকে আমরা