বাংলাদেশ, , শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

নোংরা প্রথার বলি

বাংলাদেশ পেপার ডেস্ক ।।  সংবাদটি প্রকাশিত হয়ঃ ২০২০-০৫-১৯ ০১:০৮:৪৭  

গণি মিয়ার ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠে৷ ডিউটি টাইমে ফোন আসলে তিনি একটু বিরক্ত হয়ে যান। কিন্তু এবার বিরক্ত হলেন না। কারণ তাঁর মেয়ে হালিমা ফোন করেছে৷

‘হ্যালো মা, কেমন আছিস তুই?

‘ভালো আছি আব্বা। তুমি কেমন আছ?’

‘আমি ভালো। তোর জামাই, শশুড়-শাশুড়ি সবাই কেমন আছে?’

‘সবাই ভালো আছে। আব্বা একটা কথা ছিল।’

‘তো বল! অনুমতি নিয়ে বলবি নাকি? ধুমধাম সব বলে ফেলবি আমাকে।’

‘আমার শশুর বাড়ির লোকজন ইফতারি দিতে বলছে। তোমাকে ইফতারি দিতে হবে৷’

‘তো কাঁদস ক্যান? ইফতারি তো দিব৷ আমাদের সমাজে তো এটা একটা প্রথা হয়ে গেছে। রমজান আসলে, কোরবান আসলে এবং বিভিন্ন কিছুকে উপলক্ষ্য করে মেয়ের শশুরবাড়িতে অনেক কিছু দিতে হয়। কয়েকটা দিন সময় দে। আমি ইফতারি নিয়ে আসব। তুই চিন্তা করিস না৷’

এই বলে ফোনটা রাখলেন। গণি মিয়া পেশায় একজন ট্রাফিক পুলিশ। যা মাইনে পায় তা দিয়ে কোনোরকমে চলে। ছেলে মেয়েগুলোকে অনেক কষ্টে লালন-পালক করেছেন৷ কয়েকমাস আগেই বাবুল তালুকদারের ছোট ছেলে রবিনের সাথে গণি মিয়ার মেয়ে হালিমার বিয়ে হয়েছে। রবিন হালিমার সৌন্দর্য দেখে বিয়ের প্রস্থাব দিয়েছিল। গণি মিয়াও না করেননি৷ চোখ বন্ধ করে রাজি হয়ে গেলেন এবং মেয়েটাকে তোলে দিলেন। মেয়ের শশুড় বাবুল তালুকদার মেলা টাকাপয়সার মালিক। ডজন খানেক ফ্যাক্টরি আছে। টাকা পয়সার অভাব একদমই নেই৷ মেয়ের কান্না শোনে গণি মিয়া ভাবছেন সেখানে তার মেয়েটি ভালো নেই৷ মানুষ কষ্টে না থাকলে কান্না করেনা। এমন পরিবারে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন সেখানে ইফতারির জন্য মেয়েকে কি এমন বলেছে যার জন্য কান্নাও করছে! গণি মিয়া বার বার সেটাই ভাবছেন৷ কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ভাবনা গাড়ির নানা রকম হরণ আর আলোর সাথে মিশে যায়৷ গণি মিয়া আবার তাঁর ডিউটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।

দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ডিউটি করার পর পা অবশ হয়ে আসে। যদিও সেই অবশে এখন অতটা কষ্ট হয় না। অভ্যাস হয়ে গেছে। গণি মিয়া বালিশের উপর মাথা রেখে ভাবছেন কী করবেন। ইফতারি দিতে অনেক টাকা খরচ। টাকা যা আছে তা দিয়ে দিতে গেলে কম হয়েছে বলে আবার নানান কথা শোনাবে। ভাবছেন কারও কাছ থেকে ধার নিবেন৷ মোবাইলটা হাতে নিয়ে তাঁর বন্ধু হাকিম আলীকে ফোন করলেন।

‘কেমন আছিস গইন্না? অনেকদিন পর হঠাৎ কল দিলি!’

‘ভালো। তুই কেমন আছিস? বউ বাচ্ছারা কেমন আছে?’

‘ভালো আছে।’

‘একটা কথা বলার জন্য তোকে ফোন করেছি। কিন্তু কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না।’ মিনমিন করে বললেন গণি মিয়া।

‘কি বলবি বল। এত সংকোচ না করে বলে ফেল।’

‘মেয়ের শশুর বাড়িতে ইফতারি দিতে হবে। আমার কাছে এখন অত টাকা নেই। তুই কিছু টাকা ধার দিলে উপকার হয়। আমি সময় করে তোকে পরিশোধ করে দিব।’

‘আরে ইফতারি টিপতারি এগুলা দেওয়ার কি দরকার? কোটিপতির ছেলের কাছেই বিয়ে দিছস। ওদের কি কোনকিছুর অভাব আছে নাকি? অভাব থাকলে না-হয় একটা কথা। না দে এসব ইফতারি টিপতারি।’

‘না রে ভাই। ইফতারি দিতেই হবে৷ না দিলে কত কথা শোনতে হবে! আমাদের তো আর শোনতে হবে না৷ শোনতে হবে আমাদের মেয়েকে। আর সে আড়ালে গিয়ে নিজে নিজে চোখের জল ফে…

‘ফেলবে’ বলার আগেই কুক কুক করে শব্দ করে কেটে গেল। গণি মিয়ার মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ৷ হাকিম আলীও সেদিক থেকে আর ফোন করল না।

কোনো উপায় না পেয়ে নয় মাস কষ্ট করে টাকা জমিয়ে বউকে উপহার দেওয়া হাড়টি বেঁচে দিলেন। যা পেয়েছে তা দিয়ে নানান রকম জিনিসপত্র নিয়ে মেয়ের শশুর বাড়িতে উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দশতলা বাড়ি৷ নিচ থেকে উপরে তাকাতে হলে মাথাটা ৪৫ ডিগ্রি বাঁকা করতে হয়। দরজার সামনে এসে কলিং বেল চাপতেই শ্যামবর্ণের এক যুবতী দরজা খুলে দিল। সে রহিমা। বাবুল তালুকদারের বাড়িতে কাজ করে।

‘আপনে কেডা?’

‘আমি হালিমার বাবা’

‘ও… আহেন আহেন৷ ভিত্রে আহেন।’

গণি মিয়া ভেতরে গিয়ে বসলেন।

‘আপামনি, দেহেন কেডা আইছে’ হালিমাকে ডাকল রহিমা।
হালিমা এসে চমকে গেল এবং ‘আব্বা তুমি?’ বলে গণি মিয়াকে জড়িয়ে ধরল।

‘হ। এইমাত্র আসলাম’

‘তুমি না বলে না জানিয়ে চলে আসছ যে?’

‘ক্যান মা? আমি আমার মেয়ের কাছে না জানিয়ে আসতে পারি না?’

‘তা না আব্বা। তুমি আসবা জানলে অনেক কিছুর আয়োজন করতাম। কত খুশি হতে তুমি!’

‘মা রে, বাপের কাছে মেয়েকে দেখতে পারার মত সুখ আর কিছু নেই। আয়োজনে না, আমি তোরে দেখলেই খুশি থাকি।’

‘আচ্ছা তুমি বস, আমি আব্বাকে ডেকে নিয়ে আসি।’ এই বলে বাবুল তালুকদারকে ডাকতে ভেতরে গেল হালিমা। বাবুল তালুকদার ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে দু’হাত পেছনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গণি মিয়ার কাছে আসলেন। দুই বেহাই করমর্দন করলেন৷ গণি মিয়া কোলাকুলি করতে চাইলে ‘আরে এসবের দরকার নেই’ বলে বাবুল তালুকদার কোলাকুলি করলেন না এবং একটা লম্বা সোফায় বসে গেলেন। গণি মিয়াও পাশে গিয়ে বসলেন৷

‘আরে এখানে বসছেন কেন বেহাই?

‘আপনার সাথে কথা বলব, আড্ডা দিব তাই পাশেই বসলাম’

‘আসলে এই সোফায় আমি ছাড়া কেউ বসে না। শুধু আমিই বসি। অই যে সোফাটাতে বসেন৷ কাছেই তো। কথা বলা যাবে।’

গণি মিয়া সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন৷ আরেকটি সোফায় গিয়ে বসলেন। বাবুল মিয়ার আচরণ তাঁর কাছে মোটেও ভালো লাগেনি৷ গণি মিয়া হালিমাকে ডাকলেন।

‘মা আমি চলে যাব।’

‘ক্যান আব্বা? রোজা রেখে কত দূর থেকে মাত্র আসলা। চলে যাবা ক্যান?’

‘যেতে হবে মা। আজকে অফিসে ইফতার হবে। সবাই থাকবে। আমাকেও থাকতে হবে। না থাকলে নানান কথা বলবে। আমি আসি।’ বলে বাবুল মিয়াকে সালাম দিয়ে বুকভরা কষ্ট নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। হালিমা আর কিছুই বলল না। বাপের দিকে চেয়ে চেয়ে কেবল অশ্রুপাত করল৷

ক্লান্তিতে গণি মিয়ার শরীর কাঁপছে। চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবীটা যেন প্রচন্ড বেগে ঘুরছে। এক বোতল পানি কিনে বাসে উঠে গেলেন। বাস এগোচ্ছে। কিন্তু গণি মিয়ার জন্য সময় এগোচ্ছে না৷ বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে রইলেন৷ বাবুল তালুকদারের আচরণে বেশ কষ্ট পেয়েছেন। বাবুল তালুকদার ডজনখানেক ফ্যাক্টরির মালিক আর গণি মিয়া একজন ট্রাফিক পুলিশ বলে তার সাথে কোলাকুলি করলেন না। পাশে বসতে দিলেন না। সেসব মনে পড়লে গণি মিয়ার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে। গণি মিয়া ভাবে, সব কোটিপতি-ই কি এমন? নানান কথা ভাবতে ভাবতে চারিদিক থেকে আযানের ধ্বনি তাঁর কানে এসে ধাক্কা দেয়। গণি মিয়া বোতলের ঢাকনাটা খুলে “আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ও‘য়ালা-রিজক্বিকা আফতারতু” দোয়াটি পড়ে কয়েক ঢোক পানি গিলে নিলেন৷ পাশের সিট থেকে একটা মেয়ে একটা বন গণি মিয়ার দিকে এগিয়ে দিল। আর বলল, ‘কাকা, নেন। এটা খান।’ গণি মিয়া বনটা হাতে নিয়ে খেয়ে নিলেন। টিকিটে, কাউন্টারে লেখা থাকে, ‘গাড়িতে অপরিচিত কেউ কিছু দিলে খাবেন না৷’ কিন্তু গণি মিয়া খেয়ে নিলেন। তিনি মনে করেন, “যে মানুষকে ইফতার করায় তার কোন খারাপ উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।”

কিছুদিন কেটে যায়। এদিকে হালিমার শশুর বাড়ির লোকজন হালিমাকে নানান কথা বলে অপমান করে। ইফতারি যা দিয়েছে তা অনেক কম হয়েছে বলে দাবি করে। হালিমা কিছুই বলে না। চুপ করে থাকে।

বাবুল তালুকদার হালিমাকে ডেকে বললেন, ‘কিরে বউমা? তোমার বাপ ফকিরকে ভিক্ষা দিচ্ছে মতো এইটুকু ইফতারি দিয়ে গেল। এটা কোন ধরনের কারবার? এর চেয়ে বেশি আমি রাস্তার ফরির গুলোকে দিই। আর কাপড় কই? এইটুকু ইফতারি নিয়ে নাচতে নাচতে চলে এলো। ঈদের জন্য যে কাপড় দিতে হয় তা জানে না? আমাদের সবার জন্য এবং সব আত্মীয় স্বজনদের জন্য কাপড় পাঠাতে বলবে।’

‘আব্বা তো একজন সাধারণ ট্রাফিক পুলিশ৷ অল্প মাইনে পায়। যতটুকু পেরেছে দিয়েছে। আবার এখন এতজনের জন্য কাপড় কিভাবে দিবে?’

‘কিভাবে দিবে মানে? আমরা দিই না? আমাদেরও মেয়ে আছে তো। তাদের বিয়ে দিয়েছি তো। তাদের শশুরবাড়িতে কী কী দিয়েছি জানো না?’

‘আপনাদের তো কিছুরই অভাব নাই। এভাবে প্রতিদিন দিলেও সমস্যা হবে না৷ কিন্তু আমার আব্বার তো সেই সামর্থ্য নেই৷ কোনরকম চলে।’

‘সামর্থ্য? এরা কি করে আমি জানি না? কতটাকা ঘুস খায় জানি তো।’

‘আমার আব্বা এমন না। আব্বা ঘুস খায় না। আমি জানি আমার আব্বা কত কষ্ট করে।’

‘মুখে লাগাম দাও। এত কিছু জানি না। কাপড় দিতে বলবে। ইদের আগেই দিতে বলবে।’

হালিমা আর বাক্যব্যয় করল না। সেখান থেকে চলে গেল। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে গণি মিয়াকে ফোন করল৷

‘কিরে মা, কাঁদছিস কেন?’ হালিমার কান্না শোনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন গণি মিয়া।

‘আমাকে কোথায় বিয়ে দিলে আব্বা? কত বিলাসবহুল বাড়িতে আছি, মাটিতে পা পর্যন্ত রাখতে হয় না। প্রতিদিন কত ভালো খাবার খাই, তাও আমার ভেতরে একটুও শান্তি নেই৷ কোথায় বিয়ে দিলে আমাকে?’

গণি মিয়া অনেক আগেই বুঝতে পেরেছেন তাঁর মেয়ে শান্তিতে নেই৷ শুধু বিলাসবহুল বাড়িতে থাকা, বিলাসবহুল গাড়িতে চড়া, প্রতিদিন পোলাও কোরমা খাওয়াকে শান্তি বলে না৷ যদি মনের শান্তিটা পাওয়া না যায়। গণি মিয়ার মেয়ে হালিমার অবস্থাও তেমন। মানসিক ভাবে মোটেও শান্তিতে নেই৷ তাও কিছু না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ক্যান? কি হয়েছে?’

‘আমার শশুর বাড়ির লোকজন ইফতারি নিয়ে মোটেও খুশি না। কিন্তু আমি বুঝি তুমি কত কষ্ট করে ইফতারি দিয়েছ। আর সেদিন কেন চলে গেছিলে সেটাও বুঝেছি। এখানের সবাই এখন ঈদের পোশাক চাইছে। সব আত্মীয় স্বজনদের জন্য সহ।’

গণি মিয়া চুপ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ‘আচ্ছা দেখি’ বলে ফোনটা রাখলেন।

গণি মিয়া এখন ভাবছেন সে একজন সাধারণ ট্রাফিক পুলিশ হয়ে এত বেশি উচ্চ পর্যায়ের মানুষের হাতে মেয়েকে তুলে দেওয়াটা যেন তাঁর জীবনে করা ভুল গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভুল। এই অবস্থায় এতগুলো মানুষের জন্য কাপড় দেওয়ার মত সামর্থ্য গণি মিয়ার নেই৷ গয়না ছিল শেষ সম্বল। তা বেঁচে ইফতারি দিয়েছে। তাও বলছে কম হয়েছে। কিছু মানুষকে কলিজা কেটে খাইয়ে দিলেও সারাজীবন বলবে, ‘কম হয়েছে।’

গণি মিয়া অনেক চেষ্টা করেন। শশুর বাড়িতে মেয়েটি যেন একটু সুখে থাকে সেটার জন্য বাবারা সবকিছু করে। গণি মিয়া তাঁর সততাকে বিসর্জন দেয়৷ ঘুস নেওয়া সহ যত ধরনের নোংরামি আছে সবই শুরু করেন। তাও এই অল্প দিনে বেশি কিছু করতে পারেননি। মেয়ের জামাইয়ের জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনে সেটা পাঠিয়ে দেন৷ এর পরই হালিমাকে নানান কথা শোনাতে থাকে তার শশুর বাড়ির লোকজন। তার বাপকে গালাগাল দেয়। সে সব সহ্য করলেও বাপকে এভাবে গালাগাল দেওয়াটা সহ্য করতে পারল না। কারও কথার কোনো জবাবও দিল না। কেবল শোনে গেল।

রাতে সবাই ঘুমে পড়ে৷ নতুন সকালের জন্য সবাই অপেক্ষা করে। নতুন সকাল হয়েছে। সবাই সকালে ঘুম থেকে উঠে৷ কিন্তু হালিমা উঠেনি। সে অকালে মরণের পথ বেছে নিয়েছে।

হালিমা ঝুলছে

এমন কত হালিমা ঝুলে
তবুও যায় না সমাজের কিছু মানুষের নোংরা অহংকার,
সমাজটা আজ নোংরা প্রথায় হল অন্ধকার।

২৮/০৩/২০১৮ ইং

 

লেখকঃ

মশিউর রহমান আবির


পূর্ববর্তী - পরবর্তী সংবাদ
       
                                             
                           
ফেইসবুকে আমরা