বাংলাদেশ, , শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের ভয়াবহ স্মৃতি

বাংলাদেশ পেপার ডেস্ক ।।  সংবাদটি প্রকাশিত হয়ঃ ২০২০-০১-১৪ ০৪:০১:০০  

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সব চেয়ে বেশি অবধান রাখে গার্মেন্টস সেক্ট৷কিন্ত এই গার্মেন্টস সেক্টরকে ঘিরে আমাদের আছে কিছু ভয়াবহ স্মৃতি,কিছু অব্যক্ত কান্না৷

প্রতিটা গার্মেন্টস এর মূল চালিকা শক্তি সেই গার্মেন্টসের কর্মী৷ কিন্ত বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন গার্মেন্টসে নানা দূর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত ও  পঙ্গুত্ব বরণ করেন হাজারো গার্মেন্টস কর্মী।তবে তাতে শুধু একজন কর্মী নিহত হয় নাহ, নিহত হয় একটি পরিবার।

 

সরকারি হিসেবে স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ধসে পড়ার ঘটনায় ৬৩ জন শ্রমিক মারা যায়। কিন্তু নিখোঁজ ছিল অনেক ।

বাংলাদেশে যখন তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ড এবং রানা প্লাজা ধসে পড়ার ঘটনায় দায়ীদের বিচার নিয়ে অনেকে সোচ্চার তখন স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ধসে পড়ার ঘটনা অনেকেই ভুলেই বসেছিলেন।

স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ধসের ঘটনায় বিচার চেয়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন মিলে ২০০৫ সালেই হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেছিল।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মধ্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্র , ব্লাস্ট এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি অন্যতম।

সেই রিটে বিবাদী করা হয়েছিল ছয়টি মন্ত্রণালয়ের সচিব , ঢাকার জেলা প্রশাসক , বিজিএমইএ , প্রধান ফ্যাক্টরি পরিদর্শক, সাভার ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক, বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট ও স্পেকট্রাম গার্মেন্টসের মালিককে।

 

আদালত সবার উপর কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করে। কিন্তু বিজিএমইএ ছাড়া বাকিরা তার কোন উত্তর দেয়নি। গত আট বছরে সেই রিটের কোন অগ্রগতিও নেই। তাহলে বিষয়টি এখন কোন পর্যায়ে ?

রিটের পক্ষের অন্যতম আইনজীবী ইকবাল কবির বলেন, “এখন মামলাটি তালিকার মধ্যে অপেক্ষমান আছে হিয়ারিং–এর (শুনানি) জন্য। ”

মি: কবির বলেন অনেক সময় আইনজীবীরা এ ধরনের রিটের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেবার চেয়ে তাদের ব্যক্তিগত মক্কেলদের মামলায় বেশি গুরুত্ব দেয়। সেজন্য শুনানিতে দেরি হয় ।

তিনি বলেন কোন পক্ষ যদি মামলার শুনানিতে যথাযথ সময় না দেয় তাহলে আইন মোতাবেক মামলার গুণাগুণের উপর ভিত্তি করে সেটির নিস্পত্তি হবে। বিষয়টি নিয়ে হতাশ হবার কোন নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন ।

আইনজীবীরা যে ব্যাখ্যাই দেন না কেন, ঘটনার শিকার ব্যক্তিরা মনে করেন তারা এর কোন বিচার পাবেন না। স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ধসের ঘটনায় একটি হাত হারিয়েছেন শ্রমিক নুর-এ-আলম ।

তিনি ২০১৪ সালে বলেন , “আমরা মনে করি এর কোন বিচার হবে না । নয় বছর হয়ে গেলো আর কীভাবে আশা করি। হওয়ার হইলে আরো আগেই হইত। ”

বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা বলছেন স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ধসে পড়ার ঘটনায় স্পেনের একটি কোম্পানি শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। এর বাইরে মালিকের দিক থেকেও শ্রমিকদের কিছু টাকা দেওয়া হয়েছিল।

শ্রমিকদের আর্থিকভাবে সহায়তা করলেও ভবন ধসের ঘটনায় সংশ্লিষ্টরা দায় এড়াতে পারেন না বলে উল্লেখ করেন শ্রমিক নেতা রায় রমেশ চন্দ্র ।

তিনি বলেন আইএলও’র নিয়ম অনুযায়ী বিচার বিশ্লেষণ করে তখনকার দিনে নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে সাড়ে তিন লাখ থেকে সাড়ে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল। সেই টাকা দিয়েছিল স্পেনের একটি কোম্পানি ইনডিটেক্স। এর পাশাপাশি স্পেকট্রাম মালিক পক্ষের দিকে থেকে দুই দফায় নিহত শ্রমিকদের প্রতিটি পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছিল ।

অপর দিকে রানা প্লাজা ও তাজরিন ফ্যাশনে আগুন স্পেক্ট্রামের এর মতই ভয়াবহতার রেশ ধরে রেখেছিল।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। সন্ধ্যার পরপরই জ্বলে ওঠে, আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরিন গার্মেন্টস। প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও ধোঁয়া আর আগুনের উত্তাপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করেন আট তলা ভবনটিতে কর্মরতরা। কিন্তু ভবনের প্রধান ফটক তালাবন্ধ থাকায় সেদিন আগুনে পুড়ে প্রাণ হারান তাজরিনের ১১৩ জন শ্রমিক। আর বাকিরা প্রাণে বেঁচে গেলেও অনেকেই আহত হন। বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের চোখে এখনও জ্বলজ্বলে সেদিনের সেই ভয়াবহ স্মৃতি।
ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, প্রথমে আগুন লাগলে বুঝতে পারিনি আমরা। কাজ বন্ধ করে জিজ্ঞাসা করি সবাইকে কি হয়েছে। এরপরেই দেখি পুরো ফ্লোর ধোঁয়ায় অন্ধকার। অনেকের লাশ পাওয়া যায়নি। লাশের চিহ্নও পায়নি। টাকা পয়সাও পায়নি।
দুর্ঘটনার পর আহতদের চিকিৎসাসহ ক্ষতিগ্রস্তদের অর্থ সহায়তার ব্যবস্থা করা হয় সরকার, বিজিএমইএ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। তবে, সে সব পদক্ষেপে অস্বচ্ছতার অভিযোগ তুলে বঞ্চিতদের সহায়তা করার দাবি জানায় শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।
২০১২ সালের তাজরীনে তারা জ্বলেছিল আর ২০১৩ সালে আগুনের শিখা নয়, তাদের ওপর ধসে পড়েছিল আস্ত ইমারত—রানা প্লাজার সমস্ত রড, ইটসহ পুরো ভবনটিই। তারপর বাক্সবন্দী লাশ হয়ে তারা সংখ্যা হয়ে যায়। হৃদয় আছড়ানো আর্তনাদ নিয়ে স্বজনেরা ছোটে ছবি বুকে নিয়ে, ছবির সঙ্গে সাদা কাপড়ে জড়ানো লাশটির মধ্যে লাগানো সংখ্যার ঘষাঘষি হয়, জন্ম হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বুকছেঁড়া কষ্টের, বিশ্বাসের—এটিই আমার স্বজনের লাশ। অনেকের লাশও মেলেনি। তেমনই এক নারীর ছবি দেখেছিলাম। মেয়ের ছবি বুকে চেপে আছড়ে পড়ে আছেন একটি কবরের ওপর। তিনি মেয়েটির লাশ পাননি। হাতে মাত্র একটি সিরিয়াল নম্বর। তাঁকে বলা হয়েছিল, ওই নম্বরের লাশটি ওখানে কবর দেওয়া হয়েছে। শ্রমিক মেয়েটিকে দেখিনি, কিন্তু দেখেছিলাম সেই মাকে, যাঁর চোখ ডুবে ছিল একটি সিরিয়াল নম্বরের প্রতি আর তিনি কবরের নম্বর দেখে মিলাচ্ছিলেন তাঁর হাতে থাকা নম্বরটি।

এ স্মৃতি ভুলে যাওয়ার নয়। হ্যাঁ, এ দেশেই, শ্রম দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা, সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শ্রমিক হত্যার ঘটনা ঘটেছিল ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। সেদিন রানা প্লাজার আটতলা ভবন ধসে পড়ে এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছিল ১ হাজার ১৩৬ শ্রমিকের। ৩০০ জন নিখোঁজ হয়েছেন এবং ২ হাজার ৫০০ জন আহত হয়েছিলেন। অথচ রানা প্লাজার মতো হৃদয় বিদীর্ণ করা ঘটনাকেও প্রথম কয়েক দিন সরকার ‘ঝাঁকুনি’তত্ত্ব দিয়ে মোড়কবদ্ধ করতে চেয়েছিল। তাই হয়তো জীবনগুলো শেষ হয়, বেঁচে থাকাদের জীবনও জীবন্মৃত হয়ে ওঠে, কিন্তু এখনো হলো না যেটি, তা হলো বিচার।

ক্ষতিপূরণ কি মিলেছে?
২০১৪ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে রানা প্লাজায় নিহত–নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজন ও আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করে সরকারি উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি। সেই কমিটির সুপারিশ অনুয়ায়ী নিহত ও নিখোঁজ প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবার এবং স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া শ্রমিক ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবেন। আর আহত হওয়ার ধরন অনুযায়ী শ্রমিকদের পাওয়ার কথা দেড় লাখ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত লাখ টাকা। কিন্তু ওই টাকা দিতে রাজি হননি পোশাকশিল্পের মালিকরা। আহত শ্রমিকদের ভেঙে ভেঙে কিছু টাকা দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে, যেটা পরবর্তী সময়ে কিছু একটা করে জীবন চালানোর মতো কাজে আসেনি। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে যে অর্থ শ্রমিকদের দেওয়া হয়েছে, সেটি ছিল অনুদান, ক্ষতিপূরণ নয়। যে হিসাব করে শ্রমিকদের টাকা দেওয়া হয়েছে, তা খুবই সামান্য। আহত শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির পরিমাণ ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। কারণ, যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখনো মানসিকভাবে স্থির হননি। যে ভয়, আতঙ্ক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ততার স্মৃতি তাঁদের প্রতিনিয়তই নিয়ে যায় সেই দিনটিতে, সেই শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ কীভাবে দেওয়া হবে, সেটি খুবই কম আলোচিত হয়েছে।

এখনো কাটেনি আঁধার
রানা প্লাজা বিষয়ে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের এ বছর প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী আহত পোশাকশ্রমিকের ৫১ শতাংশ বর্তমানে বেকার। তাঁদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ শারীরিক ও ২৭ শতাংশ মানসিক দুর্বলতার কারণে কাজ করতে পারছে না। তবে আহত শ্রমিকদের ৪৯ শতাংশ পোশাক কারখানায়, টেইলারিং, দিনমজুরি, কৃষিসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। তাঁদের কেউ কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসাও করেন। আহত সাড়ে ২০ শতাংশ শ্রমিকের শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। তাঁরা মাথাব্যথা, হাত-পায়ে ব্যথা ও কোমরব্যথায় ভুগছেন। সাড়ে ২৮ শতাংশের অবস্থা ভালো। বাকি ৫১ শতাংশ শ্রমিকের শারীরিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। তবে প্রায়ই তাঁরা নানা সমস্যায় ভোগেন। আবার সাড়ে ১০ শতাংশ শ্রমিক মানসিকভাবে সুস্থ নন। সাড়ে ৬৮ শতাংশ শ্রমিকের মানসিক অবস্থা কমবেশি স্থিতিশীল। আর ২১ শতাংশ শ্রমিক মানসিক সমস্যা কাটিয়ে উঠেছেন। আহত শ্রমিকদের মধ্যে ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ পুনরায় পোশাক কারখানার কাজে ফিরে গেছেন। তবে ২ শতাংশ শ্রমিক দিনমজুরি করছেন। আড়াই শতাংশ শ্রমিক বাসাবাড়ির কাজ করছেন। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো ১৭ এপ্রিল ২০১৯)

সেই ঘটনার পর বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানার পরিবেশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্রেতাদের উদ্বেগ এবং তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষে কারখানার বিদ্যুৎ ও অগ্নিনিরাপত্তা, অবকাঠামো ঝুঁকি, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও কর্মপরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয় উন্নয়নে কার্যক্রম শুরু করে ক্রেতাদের দুটি জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স। এখন হয়তো পরিবেশ ও কারাখানা ভবনের উন্নতি হয়েছে। ভবনের ভেতরে আতঙ্ক কিছুটা কমেছে। তবে শ্রমিকের নিরাপত্তা শুধু কারখানা ভবন ও কারখানার ভেতরের যন্ত্রপাতির নিরাপত্তা দিয়ে নিশ্চিত করা যায় না। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যঝুঁকি, আবাসন ও পরিবহন সুবিধা—সবই শ্রমিকের নিরাপত্তা প্রশ্নে খুবই গুরত্বপূর্ণ। সেদিকে উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনার কথা এখনো শোনা যায়নি। বাংলাদেশের পোশাককর্মীদের বেতন এখন পর্যন্ত পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম।

প্রতিবেদনঃ

আমির,মুনতাকিম, সামি,সৌরভ, সাকিব

এবং

তাহমিনা।


পূর্ববর্তী - পরবর্তী সংবাদ
       
                                             
                           
ফেইসবুকে আমরা