গার্মেন্টসের মূল চালিকা শক্তি বর্তমানে নারীরা!

প্রকাশিত: ৫:০৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৩, ২০২০

বাংলাদেশের গার্মেন্টসগুলোর প্রায় শতকরা ৮০ জন কর্মীই হচ্ছে নারী! ওভারটাইমসহ নারী শ্রমিকরা প্রতিদিন গড়ে ১০ ঘণ্টা শ্রম দিয়ে থাকেন। ২৯শে আগষ্ট- দেশে প্রথমবারের মতো নারী পোশাক শ্রমিকদের জন্য সরকারী হোস্টেল নির্মাণ কাজ শুরু হয় । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই হোস্টেলের ভিত্তিফলক উম্মোচন করেন। সাভারের আশুলিয়ায় নির্মিতব্য এ হোস্টেলের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৭ কোটি টাকা। ১২ তলা বিশিষ্ট হোস্টেল নির্মাণের ফলে প্রায় তিন হাজার নারী শ্রমিক আবাসন সুবিধা পাবেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তাছাড়া ও গার্মেন্টস সেক্টরে নারীদের দেয়া হচ্ছে যাতায়াত, চিকিৎসা ওভারটাইম এবং গর্ভকালীন ছুটিসহ নানা ধরনের সুবিধা!
তবে এসকল সুবিধার পাশাপাশি রয়েছে কিছু অসুবিধাও! এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চালু অবস্থায় এখনও তালাবদ্ধ রাখা হয় ১১ শতাংশ গার্মেন্টস কারখানা। এ ছাড়া ২২ জন নারী একটি টয়লেট শেয়ার করেন, যা কিনা খুবই মারাত্মক একটি অসুবিধা! প্রতিষ্ঠানের বাইরেও নারী শ্রমিকদের কিছু বিপত্তির সম্মুক্ষীন হতে হয়! কর্মক্ষেত্রে আসা যাওয়ার পথে সন্ত্রাসী ও বখাটেদের উৎপাতের সন্মুখীন হতে হচ্ছে নারী শ্রমিকদের। ২০১৩ সালের ২৩শে জানুয়ারি মানিকগঞ্জে যাত্রীবাহী বাসে এক নারী গার্মেন্টস কর্মী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল!
তবে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার সার্থে আইনগত ব্যাবস্থার পাশাপাশি সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে! নারী শ্রমিকরা এতে উৎফুল্ল ভাবে কাজে নিয়োগ দিতে পারছে! শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং মাঠ পর্যায়ে কাজ করার প্রশিক্ষণের অভাবে অন্যত্র জীবিকার ব্যাবস্থা না করতে পারায় গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করে হতদরিদ্র নারীরা একদিকে উপকৃত হচ্ছে অপরদিকে দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল হচ্ছে।

তবে , দৈনিক প্রথম আলোর ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখের পেছনের পৃষ্ঠার হেডলাইন- ‘গার্মেন্টসে নারী শ্রমিক কমছে’। এতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ার মূল কারণ প্রযুক্তিগত পরিবর্তন। এখানেই বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতের একটা বড় বিপদের ‘অশনিসংকেত’ পাওয়া যাচ্ছে। আজকের কলামটা এই বিষয়েই। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বিকাশের প্রাথমিক পর্বে, মানে বিংশ শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে কর্মসংস্থান হওয়া শ্রমিকদের ৯০ শতাংশেরও বেশি ছিলেন নারী। ওই ফ্যাক্টরিগুলোর সিংহভাগই ছিল ‘কাটিং অ্যান্ড মেকিং’, মানে সেলাইনির্ভর ওভেন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি; নারী শ্রমিকরা যে কাজগুলোতে পুরুষদের চেয়ে বেশি পারদর্শিতা অর্জন করতে সক্ষম হতেন। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বিচারে নারী শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা ছিল বেশি; কিন্তু মজুরি ছিল কম। এই দুটি বৈশিষ্ট্য থাকলেই শ্রমকে ‘সস্তা শ্রম’ সংজ্ঞায়িত করা যায়। ওই পর্যায়ে নারী শ্রমিকদের নিয়মিতভাবে অনেক বেশি সময় খাটিয়ে নেওয়া হতো; কিন্তু নব্বই দশক থেকে নিটওয়্যার শিল্প দ্রুত বিকশিত হওয়ার পর নিটওয়্যার ফ্যাক্টরিগুলোতে পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান নারীদের চেয়ে দ্রুত হারে বাড়তে শুরু করে। ফলে যুক্তভাবে ওভেন এবং নিটওয়্যার এ দুই ধরনের তৈরি পোশাক শিল্পের মোট শ্রমিকের মধ্যে নারী শ্রমিকের অনুপাত কমতে শুরু করে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৩ সালের এক জরিপ দেখাচ্ছে, ওই বছর পোশাক খাতে কর্মরত মোট ২৯ লাখ ৯৭ হাজার শ্রমিকের মধ্যে নারী ছিলেন ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ, আর পুরুষ ছিলেন ৪৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা যাচ্ছে, মোট ৩৩ লাখ ১৫ হাজার গার্মেন্ট শ্রমিকের মধ্যে পুরুষের অনুপাত ৫৩ দশমিক ৮২ শতাংশে পৌঁছে গেছে এবং নারীর অনুপাত কমে ৪৬ দশমিক ১৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। আরও লক্ষণীয়, পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকের মোট সংখ্যাও ২০১৩ সালের ১৭ লাখ ৪ হাজারের তুলনায় ২০১৮ সালে ১৫ লাখ ৩১ হাজারে নেমে এসেছে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে বিজিএমইএ দাবি করে আসছিল।

নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ বলা হচ্ছে, গত এক দশক ধরে পোশাক শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুত বেড়েছে। এসব যন্ত্র একই সঙ্গে অনেক কাজ করতে পারে। তাই আগে যেসব কাজ নারী শ্রমিকরা করতেন, সেগুলো এখন যন্ত্রের মাধ্যমেই হয়ে যাচ্ছে। এখন সুইয়িং, ফিনিশিং, কাটিং, এমব্রয়ডারি, নিটিং ও ওয়াশিং- মূলত এই ছয় ধরনের কাজ হয় বাংলাদেশে। নারীরা এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করেন সুইয়িংয়ে। এর পর ফিনিশিং। অন্য কাজগুলোতে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ তেমন নেই। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই নতুন কাজগুলোতে দক্ষতা অর্জনের ব্যাপারে নারী শ্রমিকরা নাকি তেমন আগ্রহ দেখান না। বরং পুরুষ শ্রমিকরা নতুন প্রযুক্তিতে পারদর্শিতা অর্জনে প্রশিক্ষণে প্রবল আগ্রহী। আর নারী শ্রমিকরা গড়ে শ্রমিক হিসেবে নাকি কাজ করেন সাত বছর। তারপর তারা সাংসারিক দায়িত্বে জড়িয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। ফ্যাক্টরি ব্যবস্থাপনায়ও পোশাক খাতের মালিকরা নারীদের নিয়োগ দেন না মূলত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। দক্ষ ও শিক্ষিত নারী ব্যবস্থাপকও পোশাক খাতে তেমন আগ্রহী হয়ে ওঠেননি। অন্যদিকে, এখন পোশাক শিল্পের মজুরি খানিকটা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরুষ শ্রমিকরাও এ খাতে কাজ পেতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

প্রতিবেদনঃ

রুম্মান ফাহিম, মাসুদুর রহমান , হুমাইরা , রাহাত