

সৃষ্টি আর ধ্বংসের খেলায় কালের গহব্বরে সমাহিত হচ্ছে ঐতিহাসিক অতীত। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের স্মৃতি চিহ্ন। তেমনি নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে ক্ষয়ে যাওয়া ইতিহাসের সাক্ষী পাংশা উপজেলার সাওরাইল ইউনিয়নের বিশই সাওরাইল পোস্টঅফিস।
রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার সাওরাইল গ্রামীণ সড়ক আর জমিদার বাড়ির কোল ঘেঁষে এক বুক প্রাচীন ইতিহাসের কান্না নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রত্ন নির্দশনযুক্ত বিশই সাওরাইল পোস্ট অফিস। অযত্নে অবহেলায় নিশ্চিহ্নপ্রায় পোস্ট অফিসটি। এই ইউনিয়নের বিশই সাওরাইল গ্রামের মাটিতে পা রাখলেই ভেসে আসে ৩ শত বছরের পুরনো ঐতিহাসিক প্রত্ন নিদর্শনের ইতিহাসের গন্ধ। অথচ নিশুতি রাতের জ্যোৎস্না ভেজা চাঁদ আজও অতন্দ্র প্রহরায় রয়েছে৷ আগলে রেখেছে প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য৷ বহন করে চলেছে পোস্ট অফিসের ক্ষয়ে যাওয়া ইট পাথরকে।
তিন শাসনামলের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই পোস্টঅফিসটি। ব্রিটিশ শাসনামল পার করে পোস্টঅফিসটি সাক্ষী হয়েছে পাকিস্তান আমলের। সর্বশেষ স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের অধীনে আসে পোস্টঅফিসটি।অথচ, অফিসটির দায়িত্বে থাকা পোস্ট মাস্টার এবং কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে, এই পোস্ট অফিসটি এখন জীর্ণতায় পরিপূর্ণ। নেই কোনো কার্যক্রম। কালের সাক্ষী হয়ে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, চোখ পড়তেই মনে হবে এ যেন কোন আস্তাকুঁড়। তবে, কাগজে কলমে এর সব কার্যক্রমই চলছে।
সরেজমিনে অনুসন্ধান করে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, পোস্ট অফিসটির যাবতীয় কার্যক্রম এখন পোস্টমাস্টার তুষার কুমার দাসের বাড়িতেই চলছে। এমন কি পোস্ট অফিসের নামের ফলকও তার বাড়ির দেয়াল ঘেষে লাগানো! আর জরাজীর্ণ অবস্থায় পরিত্যক্ত পড়ে আছে, শত বছরের ইতিহাসের সাক্ষী চার দেয়ালের বিশই সাওরাইল পোস্টঅফিসটি।
স্থানীয়রা জানান, আশপাশের প্রায় ১৪টির অধিক গ্রামের মানুষের ডাক সম্পর্কিত যাবতীয় কার্যক্রম চলে এই পোস্ট অফিসের মাধ্যমে। অথচ, নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এখন আর মেলে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। যেটুকু মেলে, তাও অনেকটাই অনিয়মিত।
স্থানীয়রা বলছেন, পোস্ট অফিসটির পিছিয়ে যাওয়ার শুরুটা হয়েছিল বর্তমান পোস্ট মাস্টার তুষার কুমার দাসের হাত ধরেই। এমন কি নিয়ম নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পোস্ট অফিসের কার্যক্রম এখন নিজের বাড়িতেই নিয়ে গিয়েছেন তিনি। পোস্ট অফিসটির সাথে সম্পৃক্ত সকল কার্যক্রমের জনবলই তার পরিবারের! পিয়ন পদে রয়েছেন তার ভাতিজা অনিক কুমার দাস আর রানার হিসেবে কাজ করছেন আপন ভাই সমীর কুমার দাস।
গ্রামটির এক বাসিন্দা মিন্টু কুমার দাস জানান, “আমার পিতা নিহার রঞ্জন দাস ছিলেন এই পোস্ট অফিসের পিয়ন। সম্প্রতি বাবা মারা যান। তার পুত্র হিসেবে এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকায় আমি পদটির জন্য আবেদন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পোস্ট মাস্টার এই পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না টাঙিয়ে গোপন রাখেন। তার ভাতিজা অনিককে একমাত্র আবেদনকারী হিসেবে নিয়োগ দিতে, নিজের ভাই এবং অপর এক ব্যক্তিকে দিয়ে পিয়ন পদে নিয়োগের আবেদন করেন। তাদের পরিকল্পনা আর ভাবনা অনুযায়ী, শুধু পরীক্ষায় অংশ নেয় অনিক। আমাকে বঞ্চিত করে চাকরি দিয়ে দেয় অনিককে। আমি এর সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানায়।”
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সরকারের পোস্ট অফিস আধুনিকায়নের সকল সুবিধায় পেয়েছে এই পোস্ট অফিসটি। অথচ, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, ফটোকপির সরঞ্জাম সহ সব উপকরণই ব্যবহার হচ্ছে পারিবারিক আর ব্যক্তিগত কাজে। ভবন সংস্কার কাজের অর্থও নিয়েছেন নিজের পকেটে।
গ্রামটির আরেক বসিন্দা ইন্দাদুল জানান, পোস্ট অফিসের জন্য বরাদ্দকৃত ফটোকপি মেশিনে টাকার বিনিময়ে ফটোকপি করানো হয়। এমন কি ল্যাপটপে গান, সিনেমা ও পর্ণের মতো ভিডিও অর্থের বিনিময়ে মোবাইলে ট্রান্সফার করেন পোস্ট মাস্টার ও তার পরিবারের সদস্যরা।
এতোদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় রাখলেও সবশেষ পোস্ট অফিসের পুরো ভবনটিই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দিয়েছে পোস্ট মাস্টারের পরিবারের সদস্যরা। এখন আর বোঝারই উপায় নেই, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পোস্ট অফিসের বাস্তবিক চিত্র। পুরোটাই এখন প্রায় গল্পের কথা।
জেলা প্রধান ডাকঘরের সহকারী পোস্টমাস্টার আব্দুর রহমান জানান, জেলা প্রশাসকের সহযোগিতার মাধ্যমে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আশা করছি।
এ বিষয়ে জেলা প্রধান ডাকঘরের শহর পরিদর্শক রিপন কুমার মন্ডল বলেন, নতুন ভবনের বিষয়ে আমাদের কাছে কোন নিদের্শনা নেই। এসকল কাজ অধিদপ্তরের, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের মাধ্যমে এধরনের নতুন ভবন নির্মানের কাজ বাস্তবায়ন করে থাকেন।