সংকটে বাংলার পুতুল নাচের ইতিকথা

প্রকাশিত: ৫:৪০ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২২
সংকটে বাংলার পুতুল নাচের ইতিকথা
গ্রাম-বাংলার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ পুতুল। সত্যি বলতে গেলে, গ্রামে থেকেছে কিন্তু পুতুলের বিয়ে দেয়নি এমন ছেলেমেয়ে হয়তো একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কত ঝগড়া, খুনসুটি ছিল পুতুল খেলাকে কেন্দ্র করে। গ্রাম নয় শুধু শহরের ছেলেমেয়েদের শৈশবজুড়েও পুতুলের বিশেষ প্রভাব আছে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, যেসব শিশু ছেলেবেলায় পুতুল খেলে তারা সংসার জীবনে সার্থক হয়! পুতুল এবং পুতুল নাচ এক জমজমাট সময় পার করেছে বাংলাদেশে। পুতুল নাচ এমন একটি আর্ট যেখানে শিল্পকলার প্রায় সব উপাদান বিদ্যমান। গল্প, কবিতা, নাটক, অভিনয়, গান, নাচ, ভাস্কর্য এবং অন্যান্য দৃশ্যমান আর্টের সার্থক মিলন ঘটেছে পুতুল নাচে।

পুতুল নাচের গল্পে তুলে ধরা হতো সে সময়ের মানুষের ধর্মকথা, নীতিকথা, সুখ–দুঃখ, রঙ্গরস, হাসি-ঠাট্টা ও নিত্যদিনের জীবনাচরণ। কাঠের পুতুল অথবা সোলা দিয়ে পুতুল তৈরী করে, সেটাতে রং তুলির আচড় দিয়ে, বিভিন্ন বর্ণিল সাজে সাজিয়ে বাদ্ধযন্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে সুতা দিয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে নাচায় এই পুতুল নাচের আসরে। তবে কালের বিবর্তনে ঐতিহ্যবাহী এই পুতুল নাচ আজ প্রায় বিলুপ্তির তালিকায় নাম লিখিয়েছে।
বাংলাদেশের পুতুল নাচের কথা বলতে গেলে ধন মিয়ার কথা উল্লেখ করতে হয়। পুতুল নাচের মধ্যে নতুনত্ব এনেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত এই পুতুল নাচের কুশলী। কৃষ্ণনগর গ্রামে গিরিশ আচার্যের পুতুল নাচের একটা দল ছিল।
ধন মিয়া সেই দলে ছিলেন প্রাথমিক অবস্থায়। তার কাজ ছিল পুতুল নাচের তালে তালে গান করা। পুতুল নাচের শিল্পটিকে ভালবেসে ফেলেছিলেন ধন মিয়া। শেষ পর্যন্ত নিজেই পুতুল নাচের প্রদর্শনী শুরু করেন। তার পুতুল নাচের দলটার নাম ছিল ‘রয়েল বীণা অপেরা’। তিনি বাংলাদেশের পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে প্রদর্শিত পুতুল নাচকে নিয়ে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও। ‘বড়শি বাওয়া’, ‘বাঘের কাঠুরিয়াকে ধরে নেয়া’ এবং ‘ বৈরাগী বৈরাগীনির ঝগড়া’সহ বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী প্রদর্শন করে ধন মিয়া বিদেশেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আশির দশকে এই মানুষটা পুতুল নাচ দেখাতে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন। পুতুল নাচে মুগ্ধ করে তিনি অর্জন করেছিলেন বেশ কিছু পুরস্কার।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ফুলবাড়ী ইউনিয়নের নওদাপাড়া গ্রামের মৃত সলিম মালিথার ছেলে আব্দুস কুদ্দুস। জীবনের প্রায় সবটুকু সময় ব্যয় করে দিয়েছেন এই ‘মনহারা’ পুতুল নাচের সাথে। ১৯৭২ সাল থেকে তিনি এই ‘মনহারা’ পুতুল নাচের দলের হাল ধরে রেখেছেন। আজো দেখে যাচ্ছেন সেই স্বপ্ন। ফিরবে পুতুল নাচের সুদিন। নিজ হাতে এখনো তৈরী করে যাচ্ছেন বিভিন্ন পালার জন্য পুতুল।
আব্দুস কুদ্দুস জানান, ১৯৬৫ সালে তখন আমার বয়স ৯-১০ বছর। আমার বাবা খুবই সৌখিন মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে বিভিন্ন গান-বাজনা শেখানোর জন্য পুতুল নাচের ‘মনহারা’ পুতুল নাচের দলে নিয়ে যায়। সেখানে শুকচান মাল নামের একজন উস্তাদের কাছে নিয়ে যায় আমাকে। আমি তখন দেখতে খুব সুন্দর ছিলাম। সেখানে মাস কয়েক পুতুল নাচের বিভিন্ন গান শিখি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শাড়ী পরে পুতুলের সাথে নাচ-গান করি। এরই মধ্যে ওস্তাদের প্রিয় হয়ে উঠি। প্রায় ১৬ বছর আমি পুতুল নাচের আসরে পুতুলের সাথে মেয়ে সেজে গান করি। ৪-৫ দিন অনুষ্ঠান করলে আমি ৫০-১০০ টাকা পেতাম।
১৯৭২ সালে এই ‘মনহারা’ পুতুল নাচের দলটির দায়িত্ব আমি পায়। তখনো ওস্তাদ আমার সাথে থাকতেন। তারপর ওস্তাদ শুকচান অসুস্থ্য হয়ে মারা যান। দলের প্রায় দুর্দিন নেমে আসে। আমাদের ‘মনহারা’ পুতুল নাচের দলে ছিলো ১৪ জন সদস্য। এর মধ্যে ১০ জন গানের তালে পুতুলকে পরিচালনা করতো। বাকীরা বাধ্যযন্ত্র বাজাতো আর গান গাইতো।
১৯৭৫ সালে আমি হারমনি বাজানোর প্রশিক্ষণ নেয় কুষ্টিয়া শিল্পকলা থেকে। তারপরে দলের দুর্দিন প্রায় কাটিয়ে উঠি। একটা অনুষ্ঠানে গেলে আরেকটি অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেতাম। বেশ ভালোই চলছিলো আমাদের পুতুল নাচ। কুষ্টিয়াসহ বেশ কিছু অঞ্চলে পুতুল নাচ করে বেশ সুনাম অর্জন করি।
পুতুল নাচের স্মৃতিচারণ করে ঢাকা নৃত্যকলা একাডেমির চেয়ারম্যান ও উপমহাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী রেজওয়ান চৌধুরী বন্যা বলেন, ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের গ্রামের বাড়িতে সবচেয়ে বিত্তশালী লোকটির পেশা ছিল পুতুল নাচ। বছরে ছয়মাস পুতুল নাচ দেখিয়েই তিনি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন। এতটাই জনপ্রিয় ছিল পুতুল নাচ। কিন্তু কালের বিবর্তনে অনেক কিছুই যেমন আজ আর নেই, তেমনি নেই পুতুল নাচের সেসব সোনালি দিন।