বাংলাদেশ, , বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

আইন পেশায় প্রশিক্ষণে সংকোচ কোথায়?

বাংলাদেশ পেপার ডেস্ক ।।  সংবাদটি প্রকাশিত হয়ঃ ২০২১-১০-৩০ ১৪:২৭:৩৫  

পেশাজীবিদের মধ্যে আইনই একমাত্র পেশা যেখানে সমগোত্রীয়দের সাথেই আইনী লড়াই করতে হয় এবং একই সাথে বিজ্ঞ বিচারকে সন্তুষ্ট করে জিতে আসতে হয় আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি চলে জনগনের উপস্থিতিতে । তাই এ পেশাজীবিগন কে বিজ্ঞ বলে সম্বোধন করা হয়। আইন পেশা একটি জন সম্পৃক্ততার পেশা,সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর নানান রকম মানুষ নিয়েই এখানে নিত্য চলাফেরা। আইন পেশাকে মানুষ রাজকীয় পেশা হিসাবে যেমন দেখে, তেমনি কিছু আইন পেশাদারের ব্যবহারের কারণে এ পেশা সম্পর্কে খারাপ ধারনার ও সৃষ্টি হয় যেমনঃ বটতলার উকিল ও শুনতে হয়।

আইনজীবী বা কোর্ট অফিসারদের কে সমাজের প্রথম শ্রেণী হিসাবে ধরা হয়।তাহলে কেন একদিকে এতো সম্মান আবার অন্যদিকে বিপরীত চিত্র!!
আইনপেশার একটি বৈচিত্র্য হলো এখানে যেমন আইনে অনার্স মাস্টার্স করে শুধুমাত্র আইনপেশার ওপর নিবিষ্ট হওয়া লোকজন আসে, তেমনি বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার কিংবা ভিন্ন পেশার, ভিন্ন ধারার মানুষও আইন মহাবিদ্যালয়ে পড়ে যেকোন বয়সে এ পেশায় আসতে পারে; একই পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে বিসিএস এ ও তো বিভিন্ন বিষয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে এসে সবাই একসাথে চাকুরীতে যোগদান করে। তবে তাদের মধ্যে একই রকম ব্যবহার পাওয়া যায় কেন? তাদের কি কেউ তৈরী করে নেয়?
উত্তর হ্যা, তাদেরকে তৈরী করেই নেয়, তাই তাদের সবার মাঝে প্রায় একই রকম পেশাগত আচরন লক্ষ্য করা যায়,যেমনটা আইন পেশায় সবার মাঝে দেখা যায় না।

বি.সি.এস প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান ই আছে সেখানে তাদের ভূমি আইন, ফৌজদারি আইন, বিভিন্ন আইন ও বিধিসহ উন্নয়ন প্রশাসন, সুশাসন ব্যবস্থাপনা, সরকারি ক্রয়, তথ্যপ্রযুক্তি, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধি, নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ এবং দুর্নীতি দমন ইত্যাদি বিষয়ে পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রদান করা একাডেমির মূল উদ্দেশ্য। মানব সম্পদ উন্নয়নে এবং প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নে সরকারকে সহায়তা করাও সেই একাডেমির অন্যতম দায়িত্ব।

এছাড়াও সে একাডেমি কর্তৃক প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার উপর বিভিন্ন বই, জার্নাল, গবেষণাপত্র ইত্যাদি প্রকাশ করা হয়ে থাকে। একাডেমি কর্তৃক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত ও রয়েছে।

ওপরদিকে আইনপেশায় লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে আইনছাত্র, শিক্ষানবিশ আইনজীবী কিংবা আইনজীবীদের জন্য এমন উদ্যোগ নেওয়া হয় না। আসলেই কি নেওয়া হয়?

বার কাউন্সিল সদ্যপাশ করা সকল আইনজীবীদের জন্য যদি একটি বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতো, তবে একাধারে যেমন সুযোগ্য, অভিযোজনশীল এবং জ্ঞানভিত্তিক মানুষিকতার আইনজীবী তৈরি হতো, তেমনি নবীন এবং তরুন এই আইনজীবীদের এ্যানালাইটিক্যাল এবং প্রাকটিক্যাল ট্রেনিং প্রদানের মাধ্যমে তাদের কর্মদক্ষতা এবং যোগ্যতা বৃদ্ধি করা যেত।

বার এসোসিয়েশন গুলো যদি একটু উদ্যোগী হয়ে আইনজীবী ও শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করতো তবে দক্ষ, যোগ্য ও উদ্যোগী পেশাজীবী গড়ে তোলার শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষণ হয়ে উঠতে পারতো এই প্রশিক্ষণ বা ওয়ার্কশপ গুলো।

অধিকন্তু, জৈষ্ঠ্য আইনজীবী ও সম্মানিত বিচারপতিগনের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান ভাগাভাগি করারও সুযোগ থাকতো। সংক্ষেপে বলা যায়, এমন প্রশিক্ষণ শৃঙখলাবদ্ধ, দায়িত্বশীল এবং কর্তব্যনিষ্ঠ আইনজীবী তৈরির মাধ্যমে আইন অঙ্গনের উন্নয়নে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো।

শুধু মাত্র বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ ই শেষ নয়,শেখাটা হতে হবে চলমানঃ

যেহেতু আইনপেশা একটি সম্মানজনক পেশা এবং আইন পেশায় জনগনকে ও কোর্টকে একসাথে ম্যানেজ করে চলতে হয়, তাই আইনজীবীদের পাবলিক রিলেশন ম্যানেজমেন্ট কোর্স করানো দরকার । প্রফেশনাল বিহেভিয়ার বা পেশাদার আচরন, ড্রেস কোড বা পেশাগত পোশাক, সাধারণ নিয়ম বা জেনারেল ম্যানার এই ধরনের পাঠ যদি প্রথমেই না শেখায় তবে হ-য-ব-র-ল হতে বাঁধবে কোথায়?

এছাড়াও বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের মতন প্রত্যেককে বছরে ৬০ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য একটি নীতিমালা ও রাখতে পারতো বার কাউন্সিল কিংবা বার এসোসিয়েশন, তবে নতুন নতুন আইনের সাথে সাথে নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথেও পরিচয় হতো আইনজীবীদের।

শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের জন্যও কিছু কিছু প্রশিক্ষণ বা ওয়ার্কশপ করা দরকারঃ

আজকের শিক্ষানবিশ আইনজীবীই আগামীর আইনজীবী, এটা একটা নির্ধারিত ব্যবস্থা। কিন্তু শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা কোর্টমুখী নয় কেন? যেখানে অন্যান্য পেশাজীবিরা ঠিকই নিয়মিত ইন্টার্নিশিপ করে।
এটার কারণ শিক্ষানবিশ আইনজীবিদের বার এসোসিয়েশন,আর বার এসোসিয়েশনকে শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা আপন করে নিতে পারেনি, বরং দেখা যায় শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা কোর্টে যেন উদ্বৃত্তের মতন। তাদের কোন অবস্থান না থাকায় বেশীরভাগই যায় না কোর্টে আর যারা যায় তাদের কেউ আইনজীবী সেজে বসে থাকে আর কেউ বা আইনজীবী সহকারীদের সাথে মিশে যায়। বরং এদের কে কিছু প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা করালে এবং মনিটরিং করলে এরা আরো কোর্টমূখি হতো এবং আইন অঙ্গনের পরিবেশ আরো সুন্দর হতো।

শেখার শুরুটা হোক ছাত্রজীবন থেকেইঃ

একজন আইন শিক্ষার্থীর জন্য শেখার শুরুটা হওয়া উচিত ছাত্রজীবন থেকেই। তাদের কে ক্লাসের পড়ার বাইরেও ব্যবহারিক জ্ঞান ও ব্যবহারিক বিষয়ে ধারণা প্রদান করাটা দরকার। একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষা জীবন শেষে কিভাবে বারে এনরোল্ডমেন্ড হবে, কিভাবে আইনজীবী হয়, কিভাবে জজ নিয়োগ হয়, জাস্টিস নিয়োগ পদ্ধতি কি, কার ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্ট কেমন তার একটা সম্যক ধারনা থাকা প্রয়োজন। এতে করে শিক্ষার্থীদের হয়রানি হওয়া বা স্বীদ্ধান্তহীনতায় ভোগা অনেকটাই কমে যাবে।

যে প্রশিক্ষণ গুলো হতে পারেঃ

১.প্রথম ওরিয়েন্টেশন কোর্সঃ-
নতুন আইনজীবীদের জন্য বার এসোসিয়েশন ভাইবা বা সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি এই অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে বারের নিয়মকানুন, কমিটি,ড্রেস কোড,কোর্ট ম্যানার, বিশেষ চিহ্ন বা প্রতীক (যেমন কোন ফিতা কারা ব্যবহার করেন),কমিটিতে কারা আছে তাদের সহ বাকিদের পরিচিতি তুলে ধরতে পারে।

২.বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সঃ
এটি বার কাউন্সিল ৫ -১৫ দিনের একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে।
Najmul
Najmul Hossain
এতে পেশাদারিত্ব,পেশাগত আচার আচরন,বার কাউন্সিলের নিয়ম,পেশা সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে পারে।

এছাড়াও
পাবলিক ম্যানেজমেন্ট কোর্স এবং
পাবলিক রিলেশন ম্যানেজমেন্ট কোর্স করানো যায়ঃ
নতুন এডভোকেটদের জন্য তারা কিভাবে ক্লায়েন্ট ম্যানেজমেন্ট করবে, কিভাবে সাধারণ মানুষদের সাথে আচরন করবে, কিভাবে সমাজে নিজেকে উপস্থাপন করবে তার ওপর এই প্রশিক্ষন হতে পারে।

Professional Development Course বা পেশাগত উন্নয়ন কোর্সঃ
এটা বছরে ৩০-৬০ ঘন্টার একটা প্রশিক্ষণ বা ওয়ার্কশপ করা যেতে পারে। এতে নতুন প্রযুক্তি ও জ্ঞান কে আয়ত্ত করতে সহজ হবে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে নিজেকে একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাবে।
এছাড়াও আইনজীবীদের জন্য উপযোগী বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সাথে শিক্ষানবিশ আইনজীবী এবং আইন ছাত্রদের কিছু প্রশিক্ষণ রাখা যেতে পারে।

পরিশেষে, আইনজীবীদের পেশাগত আচরণের সম্যকতা ও নতুন আইনজীবীদের আরো দক্ষ এবং যুগোপযোগী করে তোলা এবং সেই সাথে সামাজিক মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহন করা এখন সময়ের দাবী।

নাজমুল হোসেন
ভাইস চেয়ারম্যান
ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি অব ল এন্ড হিউম্যান রাইস


পূর্ববর্তী - পরবর্তী সংবাদ
       
                                             
                           
ফেইসবুকে আমরা