বাংলাদেশ, , শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধের যোগাযোগ মাধ্যমে “ওয়াকি টকি”

বাংলাদেশ পেপার ডেস্ক ।।  সংবাদটি প্রকাশিত হয়ঃ ২০২১-১০-২৭ ০১:৪৫:১৯  

জসিম উদ্দীন, কক্সবাজারঃ

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিজেদের অভ্যন্তরণী যোগাযোগ রক্ষা করতে ভিনদেশী নেটওয়ার্ক ও শক্তিশালী ‘ওয়াকি টকি’ ব্যবহার করছে দুর্বৃত্তরা। ফলে অপরাধীদের অবস্থান সনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। যার কারণে অপরাধ সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে চিহ্নিত এসব অপরাধীরা। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ ও ৬ ছাত্র-শিক্ষক হত্যার পর রোহিঙ্গাদের অপরাধকান্ড চরম ভাবে আলোচনায় এসেছে। তবে এসব নিয়ন্ত্রণ কাজ করার পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও এমনটা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

ক্যাম্পে অপরাধ সংগঠিত করার পরও অপরাধীরা আড়ালে থাকার বিষয়ে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রথমত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের মোবাইল নেটওয়ার্ক নিয়ে সেদেশের সীম ব্যবহার করছে। আর ক্যাম্পে অপরাধকান্ডে রোহিঙ্গা অপরাধীরা ব্যবহার করছে নিজস্ব ওয়াকিটকি। মোবাইলের পরিবর্তে নির্দিষ্ট দূরত্বের জন্য অপরাধীরা শক্তিশালী ওয়াকিটকি ব্যবহার করার ফলে অনেক সময় অপরাধীদের পরিকল্পনা ও হামলার বিষয়টি শৃংখলাবাহিনীর অগোচরে থাকছে।

রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ হামিদ হোসেন বাংলাদেশ পেপার’কে জানান, অসংখ্য রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তদের হাতে ওয়াকিটকি রয়েছে। যেকোন অপরাধ কর্মকান্ডের আগে যোগাযোগ রক্ষায় এসব ওয়াকিটকির ব্যবহার বাড়িয়ে দেয় অপরাধীরা। বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের সীমের নেটওয়ার্ক সিগন্যাল অনেক সময় ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায় না। সেসব এলাকায় ওয়াকিটকি-ই যোগাযোগের মূখ্যম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এসব ওয়াকিটকি ও মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ক্যাম্পে অপরাধীদের সংযোগ অনেকাংশে কমে আসবে বলে মনে করেন রোহিঙ্গা এ নেতা।

একটি সূত্র দাবি করেছে, সর্বশেষ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ ও ছয় ছাত্র শিক্ষক খুনের ঘটনায় ওয়াকিটকির মাধ্যমে নিজেদের মাঝে যোগাযোগ রক্ষা করেছে হত্যাকারীরা। এ কারণে ঘটনা পর অপরাধী সনাক্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্যবহৃত নেটওয়ার্ক ট্রেকিংয়ের আওতায় আনা হলেও কাউকে সনাক্ত করা যায়নি। তবে কারা এসব ওয়াকিটকি অপরাধীদের মাঝে সরবরাহ করছে তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে বলে জানিয়েছে ক্যাম্প সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে, কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর একটি দলের হাতে গত ৪ জুলাই কক্সবাজার লিংক রোড় এলাকায় থেকে ৮টি ওয়াকিটকিসহ দুই রোহিঙ্গা গ্রেফতার হয়। এরা এসব ওয়াকিটকি ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছিল বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছিল। এছাড়াও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযানে বেশ কিছু ওয়াকিটকি উদ্ধার হয়েছে বলে ক্যাম্পে কর্মরত আইনশৃংখলাবাহিনীর সূত্র জানিয়েছে। এসব যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে, রোহিঙ্গা অপরাধীদের অপরাধ ও অবস্থান নিশ্চিত করা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে বলে মনে করেন ওয়াকিবহাল মহল।

প্রতিবেদকের হাতে আসা রোহিঙ্গা অপরাধীদের কিছু চিত্রে দেখা যায়, অস্ত্রধারী প্রতিজনের কাছে আধুনিক ওয়াকিটকি রয়েছে। গেল ৪ জুলাই ৮টি ওয়াকি টকিসহ র‌্যাবের হাতে আটক কক্সবাজার পৌরসভার সমিতি পাড়ার হাসিম মাঝির বাড়ির ভাড়াটিয়া রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ আব্বাস (৩২) এবং টেকনাফ ২৪ নম্বর ক্যাম্পের বøক-বি-১-এর বাসিন্দা নূর মোহাম্মদের ছেলে ইমাম হোসাইন (২০) প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাম্পে অপরাধমূলক কাজে শক্তিশালী ওয়াকিটকি ব্যবহারের কথা স্বীকার করেছিলেন। এসময় শৃংখলাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, তাদের পেছনে আর কারা কারা রয়েছে তাদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।

তথ্য মতে, মিয়ানমারে জাতিগত সংঘাতের পর প্রাণে বাঁচতে বিভিন্ন সময় পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সোয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সহযোগিতায় সরকার কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি শিবিরে আশ্রয় দেয় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের। আশ্রয় পাবার চার বছরে নিজেরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, খুন, অপহরণ, মানব পাচার এবং ধর্ষণসহ ১২ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি অংশ। ক্যাম্পে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের পরও অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে গেল ৪৯ মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘর্ষের ঘটনায় ২৩৪ জন নিহত হয়েছে। ১২ ধরনের অপরাধে মামলা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০১টি। এতে আসামি হয়েছে ২ হাজার ৯৪৫ রোহিঙ্গা। সর্বশেষ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ ও ৬ ছাত্র-শিক্ষক হত্যার ঘটনা সবাইকে বিচলিত করেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোহিঙ্গাদের অনেক নেতা জানিয়েছেন, বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অবস্থা এমন যে, দিনে বাংলাদেশ সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করলেও রাতে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় পুরো ক্যাম্প। কথিত ‘আরসা’ সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারাই অস্ত্রের মহড়া দিয়ে আতংক সৃষ্টি করে। সেনাবাহিনীর আদলে তৈরি করা পোষাক পড়ে থাকা এসব ক্যাডারদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও নিজেদের যোগাযোগ রক্ষা করতে ব্যবহার করে শক্তিশালী ওয়াকিটকি।

ক্যাম্প সূত্র মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথিত ‘আরাসা’, ‘আল ইয়াকিন’ ছাড়াও ১৪টি অপরাধী দল সক্রিয় রয়েছে। এসব অপরাধী দলের নেতৃত্বে চলে মাদক ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, আধিপত্য বিস্তারে সশস্ত্র মহড়, অপহরণ, মানবপাচার ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ। তাদের ভয়ে মুখ খুলতে পারেন না সাধারণ রোহিঙ্গারা। অপরাধ সংগঠিত করার আগে পুরো পরিকল্পনা সদস্যদের কাছে ওয়াকিটকির মাধ্যমে চলে যায়। ফলে অপরাধ সংগঠিত করার পরও নিরাপদে সটকে পড়তে পারে অপরাধীরা।
ক্যাম্পে রোহিঙ্গা অপরাধীদের ওয়াকিটকি ব্যবহার বিষয়ে ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন-১৪) এর অধিনায়ক (এসপি) মো. নাইমুল হক বলেন, অপরাধীরা শৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিতে বাংলাদেশী নেটওয়ার্কের পরিবর্তে ভিন্ন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে থাকে। এ কারণে তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্যপাওয়া কষ্টসাধ্য।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বাংলাদেশ পেপার’কে বলেন, দুর্বৃত্তরা অপরাধকর্মকান্ড ঘটানোর ক্ষেত্রে ওয়াকিটকি ও মিয়ানমারের নেটওয়ার্কে এমপিটি সীম ব্যবহার করছে বলে জানাযাচ্ছে। এসব কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা নিয়ে কাজ চলছে। এরই মধ্যে ক্যাম্পে নিয়োজিত আইনশৃংখলা বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থাকে এ নিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া রয়েছে।

ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, সামনে যেকোন ধরণের অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে ক্যাম্পে কর্মরত সকল সংস্থার সমন্বয় বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও।


পূর্ববর্তী - পরবর্তী সংবাদ
       
                                             
                           
ফেইসবুকে আমরা