পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের ভয়াবহ স্মৃতি

প্রকাশিত: ১১:২৩ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৯, ২০২১

রাকিবুল ইসলাম রাফি

বাংলাদেশের পাহাড়ী অঞ্চলে পাহাড়ের ঢাল ও পাদদেশে বহু পরিবার মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। ভারী বর্ষণে এসব পরিবারের ঘরবাড়ির ওপর পাহাড় ধসে বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কায় থাকেন স্থানীয়রা। তবে একপ্রকার উপায়হীন হয়েই এভাবে বিপদজনক কায়দায় পাহাড়ের নিচে বসবাস করছে বলে এপর্যন্ত বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে কাজ করা বেশ কয়েকটি সংস্থার ওয়েব সাইডে মিলেছে এমনি তথ্য।

উদাহরণ স্বরূপ কক্সবাজারের একটি পাহাড়ের কথায় আসি। কক্সবাজারের খাঁজা মঞ্জিল এলাকার একটি পাহাড়ের নিচে ৩ শতাধিক পরিবার  বসবাস করছে। এদের বেশিরভাগই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ। মৃত্যু ঝুঁকি জেনেও বিকল্প উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে বছরের পর বছর তারা এখানে বসবাস করে আসছে।

২০০৭ সালে চট্টগ্রামের সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান ১২৭ জন। এরপর দীর্ঘ ১৪ বছর পার হয়েছে, তবে থামেনি পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল। বিচ্ছিন্ন দুই-এক বছর বাদ দিয়ে প্রতিবছরই কোনও না কোনোভাবে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঘটেছে। গত ১৪ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে প্রায় চার শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবু এই মৃত্যুমিছিল থামাতে প্রশাসনের চোখে পড়ার মতো কোনও উদ্যোগ নেই।

২০০৭ সালের পাহাড় ধসে শতাধিক মানুষের মুত্যুর ঘটনার পর তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাহাড় ধসের কারণ ও প্রতিকার জানতে ১১ সদস্যের একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে৷ সেই কমিটি প্রতিবেদন দিলেও কমিটির সুপারিশ কাজে লাগানো হয়নি আজও।

২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের লালখানবাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়।

২০১২ সালের ২৬-২৭ জুন পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে দুই জন মারা যান। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান তিন জন, একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে মা-মেয়ের মৃত্যু হয়।

এছাড়াও ২০১৭ সালের ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় পাহাড় ধসে প্রাণ হারান ১৫৮ জন। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর আকবরশাহ থানাধীন ফিরোজশাহ কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান চার জন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ এলাকা পাহাড় ধসে এক শিশুর মৃত্যু হয়। বিচ্ছিন্ন দুই-এক বছর বাদ দিয়ে এভাবে প্রায় প্রতিবছরই বর্ষায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে।

সর্বশেষ গত ২৭ ও ২৮ জুলাই বৃহত্তর চট্রগ্রামের কক্সবাজারে পাহাড় ধসে স্থানীয় একটি পরিবারের ৫ জন ও দুটি রোহিঙ্গা পরিবারের ৫ জন সহ মোট ১৪ জন নিহত হয়েছে।

শুধু চট্রগ্রাম বিভাগেই নয় সিলেটেও দীর্ঘদিন ধরেই ঝুঁকি নিয়ে টিলা ও পাহাড়ের পাদদেশে ঘর বানিয়ে বসবাস করছে প্রায় আড়াই শতাধিক পরিবার। এদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। সম্প্রতি সিলেটে একাধিকবার ভূমিকম্প হলেও বসবাসকারীরা বসতি ছেড়ে যাননি। জেলা প্রশাসন থেকে কোনও ধরনের সতর্কতা কিংবা উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়নি। তবে দুর্ঘটনা ঘটলেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।

অভিযোগ রয়েছে, প্রতি বছর বৃষ্টির আগে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ অভিযান চালায় প্রশাসন। এরপর বাকি দশ মাস আড়ালে চলে যায় তাদের কার্যক্রম। নির্মম নিয়তিনির্ভর ঘটনা মনে করে প্রশাসনের নিরবতা নির্লিপ্ততায় রূপ নিয়েছে।

বাংলাদেশে পাহাড় ধস রোধে নেই টেকসই কোনো ব্যবস্থাপনা বা পরিকল্পনা। ফলে প্রতিবছরই পাহাড় ধস বা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। বর্ষা এলে এই আতঙ্ক বেড়ে যায়। এ সময় পাহাড় ধস রোধে প্রশাসনও তৎপর হয়ে ওঠে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসের মোকাবেলা প্রশাসনের ব্যাপক প্রস্তুতি নিলেও তা মূলত সাময়িক।

উল্লেখ্য, প্রায় ১৩,৭৭,০০০ হেক্টর যা দেশের আয়তনের ৯.৩৩% পাহাড়ী অঞ্চলের একটি বড় অংশ জুড়েই রয়েছে, ছোট বড় হাজারো পাহাড়। আর সরকারি এসব পাহাড়ী জমি বেদখল করে বসবাস করছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। তারা জমি দখলে নিয়ে পাহাড়ে শুধু বসবাসই করছে না তাদের হাত দিয়েই অনেক সময় পাহাড় ধসের অনেক উৎস সৃষ্টি হচ্ছে।