গডফাদার ফারুক সিন্ডিকেটের সেই ১৭ লক্ষ ৭৫ হাজার ইয়াবা ধ্বংস

প্রকাশিত: ১১:৫৩ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৩, ২০২১

এম.এ আজিজ রাসেল :
গত ৯ ফেব্রুয়ারী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ শেখ মোহাম্মদ আলী নাদিমের অভিযানে তিন দফায় উদ্ধার দেশের বৃহৎ চালান সেই ১৭ লক্ষ ৭৫ হাজার ইয়াবা ধ্বংস করা হয়েছে। ধ্বংসকৃত ইয়াবার মূল্য ৫৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ওই অভিযানে জব্দ করা নগদ ১ কোটি ৭০ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা আদালতে সোপর্দ করা হয়। মঙ্গলবার (২৩ মার্চ) সন্ধ্যায় জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব ইয়াবা ধ্বংস করা হয়। মাদক ধ্বংসকরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজিব কুমার বিশ্বাস, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দেলোয়ার হোসেন শরীফ, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মামুন উল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হেডকোয়ার্টার) পঙ্কজ বড়–য়া, সহকারি পুলিশ সুপার রাকিবুল রাজা, জেলা গোয়েন্দ পুলিশের অফিসার ইনচার্জ শেখ মোহাম্মদ আলী নাদিম ও কোর্ট ইন্সপেক্টর চন্দন কুমার চক্রবর্তী।


জেলা গোয়েন্দ পুলিশের অফিসার ইনচার্জ শেখ মোহাম্মদ আলী নাদিম বাংলাদেশ পেপারকে বলেন, জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম বেশ কিছুদিন ধরে যুবদল নেতা ফারুকের উপর নজরদারি শুরু করে। কক্সবাজারের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চালানটি ধরতে ছন্মবেশও নিয়েছিল ডিবি পুলিশ।

 

পরে বিগত মঙ্গলবার (৯ ফেব্রুয়ারী) চৌফলদণ্ডী ঘাটে খালাসের সময় ১৪ লাখ ইয়াবাসহ হাতেনাতে আটক করে ফারুক ও তার সহযোগী বাবুকে। ঘটনার তিনদিন আগে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালানটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরে খালাসের সময় আটক হয়।

এর আগে আসা চালানের বিপুল পরিমাণ ইয়াবা জমা ছিল ফারুকের নুনিয়ারছড়ার বাসায়। জমা ছিল ইয়াবা বিক্রির বিপুল অর্থও। ডিবি পুলিশ অত্যন্ত দক্ষ গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে সেটিও তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
ডিবির ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী নাদিম আরও জানান, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে সাগরপথ ব্যবহার করে ইয়াবার বড় বড় চালান নিয়ে আসে। এর আগেও একাধিকবার চালান এনেছে তারা। তাদের চক্রের সবাইকে গ্রেপ্তার করতে ডিবির অভিযান অব্যাহত আছে।
পুলিশ সুপার মোঃ হাসানুজ্জামান বলেন, অভিযানে আটকদের কাছ থেকে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। ইয়াবাগুলো কিভাবে এসেছে, কারা কারা এর সঙ্গে যুক্ত এবং তাদেরকে কারা আশ্রয়—প্রশ্রয় দিয়েছে সব তথ্য পেয়েছি। আমরা সবাইকে আইনের আওতায় আনবো।
নতুন টিম যোগদানের পর থেকে একের পর এক ব্যতিক্রমী মাদকবিরোধী অভিযান করে আলোচনায় আসে ডিবি পুলিশ। ডিবি পুলিশের তৎপরতায় সন্তুষ্ট সচেতন মহল। তবে ডিবির পাশাপাশি থানা পুলিশও তৎপর হলে মাদক নির্মূল আলোর মুখ দেখবে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ।
উল্লেখ্যঃ গত মঙ্গলবার (ফেব্রুয়ারী) চৌফলদণ্ডীর ঘাটে খালাস করার সময় ১৪ লাখ ইয়াবাসহ কক্সবাজার ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় ফারুক। এরপর তার বাড়ি থেকে ১ কোটি ৭০ লাখ নগদ টাকা এবং চাচা শশুরের বাড়ি থেকে ৩ লাখ ৭৫ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। অভিযানে আটক করা হয় ফারুকের শশুর আবুল কালাম, শ্যালক শেখ আব্দুল্লাহ, চাচী শাশুড়ি ছমিরা খাতুন এবং স্থানীয় নুরুল আমিন ওরফে বাবুকে।
ফারুকের একজন ঘনিষ্ট আত্মীয় জানান, চৌফলদণ্ডীর অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই বাড়িতে থাকা ইয়াবা বিক্রির ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা গর্তে লুকিয়ে রাখে ফারুকের শশুর আবুল কালাম ও শ্যালক শেখ আব্দুল্লাহ। এর আগে আসা চালানের ইয়াবাগুলো মজুদ ছিল আবুল কালামের বাড়িতে।
ফারুকের বাড়ি থেকে শশুর বাড়ির দূরত্ব মাত্র ২০০ মিটার। কিন্তু বাড়িটি নির্মাণাধীন হওয়ায় আবুল কালামের পরিবার থাকতেন ফারুকের বাড়িতে। টাকা গর্তে লুকিয়ে রাখার পর ৩ লাখ ৭৫ হাজার পিস ইয়াবা বস্তাভর্তি করে ছোটভাই ছৈয়দ আলমের বাড়িতে রেখে যায় আবুল কালাম।
ছৈয়দ আলমের বাসার গলির একজন মহিলা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফারুক ও তার শশুরবাড়ির লোকজন মিলে দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ব্যবসা করে আসছে। অভিযানের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইয়াবাগুলো নিজের বাড়ি থেকে বের করে ছৈয়দ আলমের বাড়িতে রেখে যায়। তাদের কাছে আরও ইয়াবা থাকতে পারে। কারণ অভিযানের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিন্ডিকেট সদস্যরা একেকজন একেক দিকে ছুটাছুটি করে।
শশুর বাড়ির লোকজন, স্থানীয় নুরুল আমিন বাবু, মৃত কালুর ছেলে সোহেল, জসিম, উত্তর নুনিয়ারছড়ার আরেকজন ফারুক, আমেনা বেগম, মধ্যম নুনিয়ারছড়ার ইয়াহিয়া, শামিমা আক্তার, সেলিমসহ বিশাল একটি সিন্ডিকেট আছে ফারুকের। তারা দীর্ঘদিন ধরে সাগরপথে ইয়াবা এনে নুনিয়ারছড়ায় খালাস করে। স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার বিরুদ্ধে এই সিন্ডিকেটকে শেল্টার দেওয়ার অভিযোগ আছে। অভিযানের পর থেকে ফারুকের গডফাদারেরা আত্মগোপনে চলে গেছে।
এদিকে ডিবির ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী আলোচিত ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন।
মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, ইনানীর হোটেল রয়েল টিউলিপ থেকে পশ্চিমে গভীর বঙ্গোপসাগরে ট্রলারে করে ইয়াবার চালান নিয়ে ৭ থেকে ৮ জন পাচারকারী অবস্থান করছিলো। পরে যুবদল নেতা ফারুক, বাবু এবং মুচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সৈয়দ আলমসহ চারজন সেখানে গিয়ে ইয়াবার চালানটি সংগ্রহ করে নিজেদের ফিশিং ট্রলারে করে চৌফলদণ্ডী ঘাটে নিয়ে যায়। ঘাটে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে ইয়াবার চালানসহ তাদেরকে আটক করে ডিবি পুলিশ।
স্থানীয়রা জানান, সাগর পথ ব্যবহার করে নুনিয়ারছড়া এখন মাদকের ডিপোতে পরিণত হয়েছে। স¤প্রতি বিলাসবহুল কর্ণফুলী জাহাজ সেন্ট মার্টিন—কক্সবাজার পথে যুক্ত হওয়ায় ইয়াবা পাচার আরও বেশি বেড়ে গেছে।
পৌরসভার মহিলা কাউন্সিলর শাহেনা আক্তার পাখি জানান, নুনিয়ারছড়ার এখনো গডফাদার ও শেল্টার দাতারা ধরাছেঁয়ার বাইরে। তাদের আশ্রয়—প্রশ্রয়ের কারণে দিনদিন সেখানে ইয়াবা কারবারি বেড়ে চলেছে। তাই গডফাদারদের আগে আইনের আওতায় আনতে হবে।
গেল বছরের ১১ নভেম্বর উত্তর নুনিয়ারছড়ার ইয়াবা কারবারি সেলিমের ভাড়া বাসা থেকে ৬০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করে পুলিশ। তিন মাসের ব্যবধানে নুনিয়ারছড়ার আরেক ইয়াবা ডন জহিরুল ইসলাম ফারুকের কাছ থেকে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় চালান জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে ওসি শেখ মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে কক্সবাজার ডিবি পুলিশ।