ধর্মপ্রাণ বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ২:২৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ১২, ২০২১

স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন উদার চেতনার অধিকারী একজন খাঁটি ইমানদার। পারিবারিকভাবেই ইসলামিক চেতনা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। ইসলামের মহানুভবতা ও উদারতার আদর্শ আজীবন লালন করেছেন বাঙালির এ মহানায়ক।

বঙ্গবন্ধুর গোটা জীবন বড় বিচিত্র, বর্ণাঢ্য আর কীর্তিতে ভরা। তার জীবনের প্রতিটি দিক নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি অনেক রচনা সম্ভার তৈরি হয়েছে। ইসলামের প্রচার-প্রসারে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকরী নানা ব্যবস্থা নিয়েও অনেক লেখা রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ধর্মবোধ ও ব্যক্তিজীবনে ধর্মীয় অনুরাগের বিষয়ে কথা বলতে বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য হাফেজ সাহেব আলীর মুখোমুখি হয়েছিলাম। তার আগে পাঠকদের একটু হাফেজ সাহেব আলীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।

১৯৬৯ সালের অক্টোবরের কথা। টুঙ্গিপাড়ার ঈমানউদ্দিন তার জন্মান্ধ ছেলে সাহেব আলীকে নিয়ে এলেন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ সাহেবের কাছে। সাহেব আলী তখন ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসার হিফজ বিভাগের ছাত্র।

গ্রাম্য সরলতায় ঈমানউদ্দিন শেখ সাহেবকে বললেন, আমার ছেলে লালবাগ মাদ্রাসায় হিফজ পড়ে। ঢাকায় তো তার দেখাশোনার কেউ নেই, আপনি একটু খোঁজখবর রাখবেন।

শেখ সাহেব তার বিখ্যাত ভঙ্গিতে বললেন, ‘এই, তুই এখানে নিয়মিত এসে দেখা করে যাবি’। এরপর থেকে প্রতি শুক্রবার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বালক সাহেব আলীর আসা-যাওয়া শুরু হল।

এক বছর পর যখন হিফজ শেষ হয়, তখন থেকে তার অবস্থান হলো বঙ্গবন্ধুর বাসায়। ছিলেন ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত। এভাবে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের আপনজন হয়ে ওঠেন অন্ধ হাফেজ সাহেব আলী।

একজন মুসলিম হিসাবেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন পূর্ণ মুমিন ও খোদাভীরু বান্দা। ১৯৬৯ ও ৭০ সালের প্রতি শুক্রবার হাফেজ সাহেব আলী বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। বঙ্গবন্ধু খুশি হয়ে তাকে হাদিয়া দিতেন। পুরো সপ্তাহের খরচ চলে যেত বঙ্গবন্ধুর বখশিশের টাকায়। এ ছাড়া সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন ধানমণ্ডি ৩২-এ।

জন্মান্ধ এ কুরআনে হাফেজের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কিসের টানে এভাবে তিনি ছুটে যেতেন বঙ্গবন্ধুর বাসায়? তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুই তো আমাকে বলেছিলেন নিয়মিত যেতে। আমি বাসার ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসে থাকতাম। নেতাকর্মীদের ভিড়ে কোনো দিন কথা হতো বা কোনো দিন হতো না। প্রায় দিন বের হওয়ার সময় তিনি বলতেন, ‘এই, তুই খেয়ে যাবি’। কথাগুলো এখনো কানে বাজে।

জীবনের এ পড়ন্ত বেলায় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সঙ্গে কৈশোরের স্মৃতিগুলো এখনো হৃদয়পটে ভাসছে অন্ধ এ হাফেজের। জীবনের শুরুর দিকে বাঙালির মহান নেতার যে ভালোবাসা ও মমতা পেয়েছিলেন, তা নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন মনে করেন তিনি।

১৯৭০ সালে লালবাগ মাদ্রাসায় হিফজ শেষ করার পর বঙ্গবন্ধু ২০০ টাকা দিয়েছিলেন। সেদিনের কথা মনে করে হাফেজ সাহেব আলী বলেন, হিফজ শেষ হওয়ার পর সমাপনী অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ছাত্রদের থেকে টাকা তোলা হচ্ছিল। আমি বঙ্গবন্ধুকে বিষয়টি জানানোর পর তিনি ২০০ টাকা দিয়ে দিলেন। সে সময় ২০০ টাকা এখনকার হিসাবে বিশাল অঙ্ক। আমি মাদ্রাসায় গিয়ে পুরো টাকা হুজুরদের দিলাম। যেখানে অন্য ছাত্ররা ২০-৩০ টাকা দিচ্ছিল, সেখানে আমি এত টাকা দেওয়ায় সবাই বিস্মিত হয়েছে। তখনই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সম্পর্কের বিষয়টি সবাই জানতে পারে।

প্রশ্ন করেছিলাম- বঙ্গবন্ধুকে তো তখন অনেক আলেম সেভাবে পছন্দ করতেন না, তো তার সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে কোনো বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল কি না? তিনি বলেন, আমি যে ধানমণ্ডি ৩২-এ নিয়মিত যেতাম, সেটি কখনো সেভাবে প্রকাশ করতাম না। আমি আমার মতোই যাতায়াত করতাম। কিন্তু টাকা দেওয়ার ঘটনার পর বিষয়টি সবার মধ্যে জানাজানি হয়ে যায়। সেভাবে কেউ খারাপ বলত না, তবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি অনেকে ভালো চোখেও দেখেনি।

হিফজ শেষ হলে রেডিও পাকিস্তানে সাহেব আলীকে কুরআন তেলাওয়াতের সুযোগও করে দেন বঙ্গবন্ধু। রেডিও পাকিস্তানের তৎকালীন মহাপরিচালককে তিনি নিজে ফোন করে বলেছিলেন হাফেজ সাহেব আলীর কথা। এভাবে জাতির পিতার পরিবারের সদস্য হয়ে যান হাফেজ সাহেব আলী।

১৯৭১-এর ১৭ মার্চ নিজের জন্মদিনে বঙ্গবন্ধু তাকে কাছে টেনে বলেন, ‘দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় বলা যায় না, তুই বাড়ি চলে যা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার চলে আসিস।’

২৬ মার্চ থেকে শুরু হল গণহত্যা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। জন্মান্ধ হাফেজ সাহেব আলী গ্রামে বসে খবর পেলেন বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের। অনুভব করলেন পিতৃ বিয়োগের ব্যথা।

টুঙ্গিপাড়ার হাফেজ সাহেব আলীর মতো পুরো বাঙালি জাতি তখন ব্যথিত। এভাবেই শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির হৃদয়ে আসন করে নিয়েছিলেন। নেতা থেকে পরিণত হয়েছেন পিতায়।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত একটানা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের প্রেসিডেন্ট হাউসে ছিলেন হাফেজ সাহেব আলী। বাংলাদেশ বেতারে কুরআন তেলাওয়াত করতেন সপ্তাহে একদিন। সম্মানী পেতেন ১৪০ টাকা। বাসার নিরাপত্তারক্ষী ও সদস্যদের নিয়ে নামাজের জামাত করতেন। রমজানে পড়াতেন খতমে তারাবি।

এভাবে খুব কাছ থেকে বাঙালির মহান নেতাকে দেখা ও তার সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছিলেন তিনি। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘খাওয়া-দাওয়া ও নামাজ পড়ানো ছাড়া তেমন কোনো কাজ ছিল না। তাই খুব কাছ থেকেই বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গ পেয়েছি। একটি আদর্শ পরিবার বলতে যা বোঝায়, তেমনটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবার। খালাম্মাসহ সবাই আমাকে আদর করতেন।

শেখ কামাল ও শেখ জামাল ভাই আমাকে তুমি করে বলতেন; বঙ্গবন্ধু একদিন শুনতে পেয়ে তাদের শাসন করে বললেন, ও কিন্তু হাফেজ, ওকে আপনি করে ডাকবি। এরপর থেকে কামাল ভাই ও জামাল ভাই আমাকে আপনি করে সম্বোধন করতেন, অথচ বয়সে আমি তাদের অনেক ছোট ছিলাম। শুধু কুরআনের হাফেজ হওয়ার কারণেই তিনি আমাকে এমন স্নেহ করতেন’।

কুরআনের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অনুরাগের কথা আমরা জানতে পারি তার লিখিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও। জেল জীবনের স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধু লেখেন ‘আমি তখন নামাজ পড়তাম এবং কুরআন তেলাওয়াত করতাম রোজ। কুরআন শরিফের বাংলা তরজমাও কয়েক খণ্ড ছিল আমার কাছে। ঢাকা জেলে শামসুল হক সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে মওলানা মোহাম্মদ আলীর ইংরেজি তরজমাও পড়েছি’। (পৃষ্ঠা ১৮০)।

মুসলিম উম্মাহর প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিচল সমর্থনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে হাফেজ সাহেব আলী ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে কথা বলেন। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ইসরাইল-ফিলিস্তিনি বিরোধে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট। ফিলিস্তিনিদের স্বতন্ত্র-স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশ বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছে একেবারে শুরু থেকেই।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুরুর দিকে যে কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ইসরাইল।

১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইসরাইল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল।

তখন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার লিখিতভাবে ইসরাইলের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করেছিল। ৫০ বছর পরও ইসরাইল প্রশ্নে বাংলাদেশের সেই অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

একজন প্রকৃত মুসলিম হিসাবে বঙ্গবন্ধু আলেমদেরও বেশ সম্মান করতেন। হাফেজ সাহেব আলী বলেন, রাজনৈতিক জীবনে মওলানা ভাসানীর সংশ্রব ছাড়াও মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ ছিলেন অনেকটা তার আপন ভাইয়ের মতো। একসঙ্গে তারা রাজনীতি করতেন। তবে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আলেম আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুব মান্যবর ব্যক্তি। নিয়মিত তার কাছে দোয়ার জন্য যেতেন বাঙালির মুক্তির এ মহানায়ক।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে খালাস পেয়ে বঙ্গবন্ধু যখন গোপালগঞ্জ গেলেন, বাড়িতে মা-বাবার কাছে যাওয়ার আগেও তিনি ছদর সাহেব হুজুরের কবর জিয়ারত করে পরে গিয়েছেন। কারণ সে বছরই আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) ইন্তেকাল করেন।

বঙ্গবন্ধু নিয়মিত পরিধান করার কারণে তার অনুরাগীদের মধ্যেও ‘মুজিব কোট’ নামে যে পোশাকটি জনপ্রিয় হয়েছে, সেটি বঙ্গবন্ধুকে আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) প্রথম হাদিয়া দিয়েছিলেন বলে অনেক আলেম বলে থাকেন।

লেখক :তানজিল আমির

তরুণ আলেম ও গণমাধ্যমকর্মী